আহমেদ ছফার খুব বেশী বই আমি পড়িনি। “গাভী বিত্তান্ত” উনার ৪র্থ উপন্যাস যা আমি পড়ে শেষ করলাম একদম এক নিঃশ্বাসে। খুবই সহজ সরল ভাষায় লেখা গভীর এনালজিকাল একটা বই। বই টা কে যদি একটা বৃত্ত হিসাবে কল্পনা করি তাহলে তার কেন্দ্রে আছে একটা গাভী। তার সবচেয়ে কাছের গ্রহ, গাভীর মালিক বিশ্ববিদ্যালয় এর উপাচার্য আবু জুনায়েদ। তারপর ক্রমাননয়ে ঘুর্নায়মান অন্যান্য চরিত্র যেমন আবু জুনায়েদ এর স্ত্রী বেগম নুরুন্নাহার বানু, আছেন অত্যন্ত প্রভাবশালি ঠিকাদার শেখ তবারক আলী। এছাড়া আরো কিছু পার্শ চরিত্র যেমন “রসায়ন” বিভাগের সুন্দরী শিক্ষিকা দিলরুবা খানম, মাওলানা আবু তাহের, তবারক আলীর জামাতা, বুয়েটপাস সিভিল ইঞ্জিনিয়ার আবেদ হোসেন, আবু জুনায়েদ এর মেয়ে দিলু এবং রেবা। এই চরিত্র রা বিভিন্ন সময়ে বই এর পাতায় এসেছেন, তাদের ভূমিকা রেখেছেন। কিন্তু আহমেদ ছফার লেখনির অন্যতম শক্তিশালী গুন হল তিনি এসব চরিত্র কে কখনোই মূল কাহিনী এবং মূল চরিত্র দের কে ছাপিয়ে উঠতে দ্যান নি।
গাভী বিত্তান্ত শুরু করার কিছুক্ষন এর মধ্যেই বোঝা যায় এটা কোন বিশ্ববিদ্যালয়কে নিয়ে লেখা। যদিও যে কোন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় এর কথা ভাবলেই এই কাহিনী কে সুন্দর ফিট করে দেয়া যায়। ছফা এই লেখা লিখেছিলেন ডিসেম্বর ১৯৯৪ থেকে ১০ ফেব্রুয়ারী ১৯৯৫ এর মধ্যে। অর্থাৎ মাত্র দুই মাস এ ছফা লিখেছিলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রেক্ষাপটে, বিশেষত বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষক রাজনীতির প্রেক্ষাপটে রচিত বাংলা ভাষার সবচেয়ে শক্তিশালী উপন্যাস হিসেবে গণ্য গাভী বিত্তান্ত যা কিনা এই ২০২৩ সালে এসেও বাস্তবার সাথে মিলে যায় হুবহু।
আমি মনে করি “আচরণ, বিচরণ ও বচন”––এই তিন ঠিক না হলে তাকে আমরা শিক্ষক বলতে পারি না। কিন্তু বাস্তবতা হলো এখন শিক্ষকদের একটা বড় অংশের বিচরণই রাজনীতির মাঠে। অনেক শিক্ষকের আচরণ দলীয় ক্যাডারের মতো। অনেকের বচন পাড়ার মাস্তানের মতো। আমার কথা গুলো লিখতে অনেক গুলো শব্দ ব্যয় হয়ে গেলো কিন্তু আহমদ ছফা তার কালজয়ী লেখনি কি অনায়াসে এই কথাটাই বুঝিয়ে দিলেন এই লাইন গুলো দিয়ে “
“আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়টির ছিল গৌরবময় অতীত। অনেকে এই বিশ্ববিদ্যালয়টিকে গোটা দেশের আত্মার সঙ্গে তুলনা করে গর্ববোধ করতেন। অতীতের গরিমার ভার বইবার ক্ষমতা বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ের নেই।’’
এই উপন্যাসের প্রধান চরিত্র আবু জুনায়েদ নামে এক অথর্ব লোকের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি হয়ে ওঠার ট্রাজেডি বর্ণনা করতে গিয়ে ছফা লিখছেন,, “সকলের দৃষ্টির অজান্তে [বিশ্ববিদ্যালয়টিতে] একের অধিক হনন কারখানা বসেছে, কারা এন্তেজাম করে বসিয়েছেন সকলে বিশদ জানে। কিন্তু কেউ প্রকাশ করে না। ফুটন্ত গোলাপের মত তাজা টগবগে তরুণেরা শিক্ষক হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢোকার পর হনন কারখানার ধারে কাছে বাস করতে করতে নিজেরাই বুঝতে পারেন না কখন যে তারা হনন কারখানার কারিগরদের ইয়ার দোস্তে পরিণত হয়েছেন। তাই জাতির বিবেক বলে মহান শিক্ষকদের কারো কারো মুখমণ্ডলের জলছবিতে খুনি খুনি ভাটা যদি জেগে থাকে তাতে আঁতকে ওঠার কোনো কারণ নেই। “
হুমায়ুন আজাদ বলে গেছেন, ‘শিক্ষকের জীবনের থেকে চোর, চোরাচালানি, দারোগার জীবন অনেক আকর্ষণীয়। এ সমাজ শিক্ষক চায় না। চোর-চোরাচালানি-দারোগা চায়।’ ফলে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা হয়তো বুঝে গেছেন যে, শিক্ষক হয়ে বেঁচে থেকে খুব বেশি লাভ নেই। তাই তারা অন্যের লেখা চুরি করে হোক আর সহকর্মীর নাক ফাটিয়েই হোক কিংবা রাজনৈতিক লেজুড়বৃত্তি–এমন একটি জীবন তারা নিশ্চিত করতে চান, যেখানে অর্থ, সম্মান এবং ক্ষমতা সবই আছে।
বই এর রিভিউ তে কাহিনী সংক্ষেপ বলাটা আমি ঠিক মনে করি না। শুধু বই এরই এক লাইন দিয়ে কাহিনী সম্পর্কে একটি ধারনা পাওয়া যায়। ছফা লিখেছেন, “দিনে দিনে গোয়ালঘরটাই বিশ্ববিদ্যালয় এর হৃদপিন্ড হয়ে উঠলো”।
উৎসাহী পাঠক এই রিভিউ পড়ে বইটিকে বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে হা হুতাশ করা একটি বই ভেবে ভুল করতে পারেন। কিন্তু সেরকম ভাবলে এই বই এর নির্যাস যে তা ছাড়িয়ে অবসেশন, নেপোটিজম, ডিক্টেটরশিপ এবং আরো অনেক কিছু নিয়ে তা থেকে নিজেকে বঞ্চিত করতে পারেন । বইটার টাইমলাইন নিয়ে অল্প কিছু রিসার্চ করতে গিয়ে দুটো মজার তথ্য পেলাম
১) ১৯৮৬ থেকে ১৯৯০ পর্যন্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ছিলেন জৈবরসায়নের অধ্যাপক আবদুল মান্নান। ছাত্রদের গোলাগুলির মাঝখানে পড়লে ‘বিশেষ যোগ্যতায়’ নিয়োগ পাওয়া বিশ্ববিদ্যালয় উপাচার্যের গর্ভবতী গাভিটি নিহত হয়
২) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০১৮ খ্রিস্টাব্দের ১২ অক্টোবর গৃহীত ‘ঘ’ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষার ফলাফল প্রশ্ন ফাঁসের অভিযোগে বাতিল করে পুনরায় নেওয়ার দাবিতে আমরণ অনশন করছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের তৃতীয় বর্ষের এক শিক্ষার্থী। আখতার হোসেন নামের ওই ছাত্র ২০১৫-১৬ শিক্ষাবর্ষের জিয়া হলের শিক্ষার্থী। বিশ্ববিদ্যালয়ের সন্ত্রাস বিরোধী রাজু ভার্স্কযের পাদদেশে মঙ্গলবার সাড়ে ১২টা থেকে অনশন শুরু করেন তিনি। আমরণ অনশনকারী প্রতিবাদ জানাতে আহমদ ছফার গাভী বিত্তান্ত বইটি পড়েছিলেন। যে ছবি বিভিন্ন জাতীয় দৈনিক এ ছাপা হয়। পরবর্তীতে ফলাফল বাতিলকৃত এবং ১৬ই নভেম্বর ভর্তিপরীক্ষা পুনরায় গৃহীত হয়।
আগের পর্বে ১৬৭০ সালের ফ্রাঞ্চেস্কো ডি লানার গপ্প যহন কইসিলাম তহন কইসিলাম যে উনি Society of Jesus নামে একটা ক্যথলিক গ্রুপ এর মেম্বার আসিলেন। ফ্লাঞ্চেস্কো লানার এই থিউরি লয়া ঠিক একশো বছর পর ১৭০৯ সালে এই সোসাইটিরই আরেকজন আগ্রহি হয়া উঠলেন। একি কেলাবের মেম্বার তো, তাই “ভাই এ কইসে” ধইরা লয়া ব্রাজিল এর এক ব্যাডায় ভাব্লেন আম্মো বানামু এয়ারশিপ। ব্রাজিলিয়ান এই ব্যডার নাম আসিল বারতোলমিউ দে গুসমাউ (Bartolomeu de Gusmão ) ।
গুসমাউ ভাইজান অনেক খাটা খাটনি কইরা পাখির মত দেখতে একটা এয়ারশিপ বানাইলেন, যার নাম ছিল পাসারোলা (passarola) । কিন্তু তাতে ফ্রাঞ্চেস্কো ডি লানার থিউরি অনুসারে গুল্লা গুল্লা বল আসিল না । এক রকমের কাগজের তৈরি বুইত্তামারা পিরামিড এর মত এনভেলপ আসিল। অঈডার নিচে উনি কি কি জানি দিয়া আগুন জালাইসিলেন আর তখনকার আমলে পর্তুগাল অধ্যুশিত ব্রাজিলের রাজা পঞ্চম জন এর সামনে ডেমো দেহাইসিলেন।
কিন্তু তখনকার মানুষ এইটার জন্য ঠিক রেডি আসিল না। তাই রাজা পাঁচ লম্বর জন এর চাকর রা তাত্তারি কইরা বেশি উপ্রে উঠনের আগেই ওই এয়ারশিপ এর আগুন নিভায়া হালাইসিল আর লুকজন জনাব গুসম রে জাদুকর, শয়তানের উপাশক এইসব হাবিজাবি কউয়া শুরু করসিল। একজন কট্টর যিশু খৃস্টের সেবক হিসাবে ব্যাপারটাতে উনি বেশ মাইন্ড খাইলেন। উনি উনার সব কাগজ পত্র পুড়ায়া ফালাইলেন আর ছদ্মবেশ নিয়া পালায় গেলেন স্পেন এ। জীবনের শেষ কয়টা দিন অইখানেই কাটাইসিলেন। পরে গুসমাউ এর এক ভাই এর কাছ থেইকা আর কিছু কাগজপত্রের সাহায্যে তার আসল কাহিনী জানন যায়। নাইলে ইতিহাস থিকা হারায়াই গেসিল আরেট্টু হইলে প্রথম “প্রায়” সফল এয়ারশিপ এর কাহিনি।
এই শতাব্দিতেই মানে আটলান্টিক এর আরেক পারে, ফ্রান্সে, মানব জাতির উড়তে শিখার পথে, আরেক লাফ আগায়া যাওয়ার ঘটনা, ঘটতে যাইতাসিল। যার নায়ক দুই আপন ভাই। না আগেই “ও রাইট ব্রাদারস! আমি তো আগেই জানতাম” বইলা ফাল পাইরেন না। এই দুই ভাই সেই দুই ভাই না। এদের পরিবারের নাম মন্টগলফিয়ার। এরা হইলেন মন্টগলফিয়ার ভাইয়েরা।
বড় ভাই এর নাম জোসেফ মন্টগলফিয়ার (Joseph-Michel Montgolfier) । ইনার এট্টু আবেগি স্বপ্ন দেখার বাতিক আসিল, মন রে উইড়া যাইতে দিতেন ইচ্ছামত। ইনারি ছোট ভাই এর নাম ইতিএন মন্টগলফিয়ার (Jacques-Étienne Montgolfier)। ইনার ব্যবসায়িক বুদ্দি আসিল সেইরাম। ইনারা দুইজন বাপের কাগজের ব্যাবসা দেখাশুনা করতেন। ইতিএন মন্টগলফিয়ার এর ব্যবসায়িক বুদ্ধির কারনে অল্পদিনের মধ্যেই তাদের কাগজের ব্যবসা বেশ বাম্পার হয়া উঠল।
একদিন ফায়ারপ্লেস এর আগুনের ধারে বয়া জোসেফ মন্টগলফিয়ার ঝিমাইতাসিলেন। বড়লুক মানুষ তো, কামকাইজ নাই, তাই ঝিমাইতাসিল মুনে লয়। ফায়ারপ্লেস এর পাসে হেগো বুয়া মুনে লয় কার জানি শার্ট দিসিল শুকাইতে। জোসেফ মিয়াভাই আতকা খেয়াল করলেন, আগুনের তাপে শার্টের পকেট ফুইল্লা উইঠা ইট্টু উপ্রে উইঠা গেল। জোসেফ ভাব্লেন, কাম সারসে, ঘটনা তো ঘটায়া লাইসি, নিজের অজান্তেই কি জানি আবিষ্কার কইরা লাইসি। তিনি ভাব্লেন আগুনেত্তে একটা ইশপেশাল গ্যাস বাইরইতাসে আর এই গ্যাস এর আসে ল্যাভিটি নামের একটা ইশপেশাল বৈশিষ্ট। এই গ্যাস এর নাম তিনি আদর কইরা দিলেন “মন্টগলফিয়ার গ্যাস”। দেখসেন তহন সবকিসুতে এট্টু নিজের নামডা ঢুকায়া দেওনের বদ্ভ্যাস আসিল মাইন্সের। সোনার তরী তে উইট্টা পরনের ধান্দা আরকি।
ব্যপারটা আরো ভালা মত বুঝনের লাইগা, জোসেফ মিয়াভাই একটা তিন ফিট বাই তিন ফিট এর কাগজের বাক্সের লাগান জিনিষ বানাইলেন। তার নিচে আগুন আনলেন আর বাক্স গেল উইরা ।
খুশিতে জোসেফ মিয়াভাই তার সুডু ভাই রে চিডি লিখলেন, ভাই আমার, তাত্তারি বাইত আয়, তরে তামশা দেহামু। আহনের সময় কুইন্নার দুকান তে বেশি কইরা সিল্ক এর কাপড় আর দড়ি লয়া আহিস। সুডূ বাই ইতিএন তো লগে লগে জিনিষপাতি লয়া হাজির। দুই ভাই মিল্লা শুরু করলেন তাগো গবেশনা আর টেষ্টিং। দুইজন মিল্লা একি রকম কিন্তু তিন গুন বড় আর একটা বাক্সের লাগান জিনিস বানাইলেন আর তার তলায় আগুন রাখলেন। রেজাল্ট হইল ব্যাপক। দুই জনের তো খুশিতে পুরা জাব্রা জাব্রি অবস্থা।
দুই ভাই যহন শিউর হইলেন যে নাহ তাগো বানানি বেলুন কাম করে, তহন তারা ঠিক করলেন, এইবার ব্যাপারটার পাব্লিক রিলিজ দিতে হইব, নাইলে আবিস্কারক হিসাবে ইতিহাস তাগোরে স্বীকার করব না। তাদের এই চেষ্টার ফল দেখা গেল ১৭৮৩ সালের ৪ঠা জুন এ। এইদিন ফ্রান্সের এনোনে (Annonay) শহরে প্রথম গরম বাতাসের বেলুন আকাশে উড়ল আর মাইন্সে আক্কইরা থাকল “এইডা আমি কি দেখলাম” ভাইব্বা। ওই দিন এর পর তাদের এই আবিস্কার এর কথা ছরায় গেল সারা ফ্রান্স এ।
ইতিএন মন্টগলফিয়ার তাগো এই নাম জশ রে কাজে লাগানো শুরু করলেন। তিনি বিভিন্ন শহরে গিয়া গিয়া সম্ভাব্য বিনিয়োগকারিদের কে ডেমো দেখায়া দেখায়া পয়সা জুগার করা শুরু করলেন। এই পয়সা পিজ্জা খাউনের পয়সা না। এই পয়সা যোগার এর উদ্দ্যেশ্য ছিল তাদের আবিস্কারকে আরো এক ধাপ আগায়া নিয়া যাওয়া। প্রথম মানুশ অলা বেলুন উড়ানো।
ওই দিকে একি সময়ে প্যারিসে আবির্ভাব হইসে আরেক রকম উড়তে শেখার সিস্টেম এর আবিশকারক এর। যার নাম “হাইড্রোজেন বেলুন”। জেকুয়েস চার্লস (Jacques Charles) নামের একজন ফ্রেঞ্চ কেমিস্ট এবং আবিষ্কারক ভাইবা দেখলেন হাইড্রজেন গ্যাস একটা ভাল লিফটিং এজেন্ট হইতে পারে। কিন্তু এইডারে ব্যবহার কইরা কেমনে “হাইড্রোজেন বেলুন” বানানি যায় ওইটা তিনি কিসুতেই সাইজে আনতে পারতাসিলেন না। তাই উনি দ্বারস্থ হইলেন আরেক দুই ভাই রবার্ট ভাইদ্বয় এর। এনি জিন রবার্ট (Anne-Jean Robert ) আর নিকলাস লুইস রবার্ট (Nicolas-Louis Robert) এই দুই ভাই মিল্লা জেকুয়েস চার্লস এর লাইগা “হাইড্রোজেন বেলুন” বানানি শুরু করলেন তাদের প্যারিস এর ওয়ার্কশপ এ।
যদি ঘুমায় গিয়া থাকেন পড়তে পড়তে তাইলে এইখানে বইলা রাখা ভাল আমি কিন্তু দুই টাইপ বেলুন এর ইতিহাস পাশাপাশি কইতাসি। মন্টগলফিয়ার ভাইদের “হট এয়ার বেলুন” আর জেকুয়েস চার্লস এর “হাইড্রোজেন বেলুন” ।
মন্টগলফিয়ার ভাইয়েরা তাগো “হট এয়ার বেলুন” প্রথম সফল পাব্লিক ডেমো করসিলেন ১৭৮৩ সালের ৪ঠা জুন, এইদিন ফ্রান্সের এনোনে (Annonay) শহরে। আর জেকুয়েস চার্লস আর রবার্ট ভাইইয়েরা তাগো “হাইড্রোজেন বেলুন” এর পরথম ডেমো করার উদ্যোগ নিলেন তার দুইমাস পর, ১৭৮৩ সালের ২৭শে আগস্ট এ। তাগো জায়গাডা আসিল এখন যেইখানে আইফেল টাওয়ার দাড়ায়া আসে, প্যারিস এর ঠিক ওই জায়গাটায়। তখন ওই জায়গার নাম আসিল শেম্প দে মারস । মজার ব্যাপার হইল তাগো ডেমো দেখতে যারা আইসিল, সেই ভিড় এর মধ্যে আসিলেন আম্রিকার অন্যতম জাতির পিতা বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিন ও। আম্রিকায় উড়তে শিখার দৌড় টা নিয়া যাওয়ার পিছনে এইডারে একটা যুগাযুগ বইলা ধইরা নেওন যায়।
জেকুয়েস চার্লস আর রবার্ট ভাইয়েরা সফল ভাবে তাগো “হাইড্রোজেন বেলুন” যার নাম “লে গ্লোব”, উড়াইলেন। “লে গ্লোব” বেলুন্টা আসিল পয়তিরিশ কিউবিক মিটার এর রাবারের লগে সিল্ক মিশায়া তৈরি। এই বেলুন্টা প্রায় পয়তাল্লিশ মিনিট উইরা প্যারিস থিকা ২১ কিলোমিটার দূরে গনেস (Gonesse) গ্রাম এ গিয়া পরসিল। গেরামের লুকজন তো এই জিনিস জীবনেও দেহে নাই তাই বেলুন্ডা মাডির কাসা কাসি আইলে বরশা, কুরাল আর যার যা আসিল সব লয়া ঝাপায়া পরসিল বেলুন এর উপ্রে। হেরা ভাবসিল হেগো গেরামে শয়তান আইসে। তাই শয়তান মারা যায়েজ করতে ইতিহাসের প্রথম “হাইড্রোজেন বেলুন” রে ছিড়াবিড়া শ্যাশ কইরা দিল।
মজার জিনিষ হইল ““হাইড্রোজেন বেলুন” এর আবিষ্কারক জেকুয়েস চার্লস আসিলেন মন্টগলফিয়ার ভাই দের “হট এয়ার বেলুন” প্রজেক্ট এর অন্যতম কলাবরেটর। তারা একে অন্যরে সাহায্য করতাসিলেন বিভিন্ন ভাবে । তখনকার আমলের ফ্রান্সের রাজাও এই তিন পাগলার কাজ কাম মনিটরিং করতাসিলেন। দুই প্রকার বেলুনের ই মানুষ ছাড়া সফল উড্যয়ন এর পর দুই দল ই রাজার কাসে প্রস্তাব করলেন যে তারা এইবার মানুষ সহ বেলুন উড়াইতে চান ।
কিন্তু অইডা বেশি রিস্ক হয়া যায়, যেহেতু তহন কেউ জানেনা উপ্রে গেলে মাইনষের উপ্রে তার এফেক্ট কি হইব। তাই রাজামশাই প্রস্তাব করলেন, জেল থিকা দুইডা ক্রিমিনাল রে ধইরা বেলুনে উডায়া দেওয়া হউক। তারপর কি হয় দেহা যাইব। কিন্তু মানুষের উড়তে শেখার এরুম একটা ইম্পরটেন্ট ব্যাপারে ক্রিমিনাল গো ইনভল্ভ করন ডা দুই দল এর কেউ ই রাজি হইলেন না।
মন্টগলফিয়ার ভাইরা একটা বুদ্দি করলেন। তারা বেলুনের লগে একটা বাস্কেট লাগাইলেন। আর ওই বাস্কেট এ রাখলেন একটা মুরগি, একটা হাস আর একটা ভেড়া। তারপর ওই ১৭৮৩ সালের ই , ১৯শে সেপ্টেম্বর ফ্রান্স এর ভারসেলিস শহরে রাজা ষোলতম লুই আর রানি মেরি এন্টইনেট এর সামনে ডেমো দেহানির ব্যবস্থা হইল। আট মিনিট উইড়া, ১৫০০ ফিট উচ্চতায় তিন কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়া এই বেলুন নিরাপদে অবতরন কইরা প্রমান করল, এখন বেলুনে মানুষ পাডানি যাইতে পারে। শুরু হইল দুই রকম বেলুন “হাইড্রোজেন বেলুন” আর “হট এয়ার বেলুন” এর প্রথম ম্যান্ড ফ্লাইট অর্থাৎ মানুষ লয়া উড্ডয়ন এর প্রস্তুতি।
মন্টগলফিয়ার ভাইয়েরা তাদের প্রথম ম্যান্ড ফ্লাইট এর বেলুন বানানির জন্য শরণাপন্ন হইলেন অয়ালপেপার বানানির কারিগর রেভেলন (Jean-Baptiste Réveillon) এর। রেভেলন তাদের ওই হাস-মোরগ-ভেড়া ওয়ালা বেলুন্টাও বানাইসিলেন। মানুষ বাহি বেলুন এর লাইগা মন্টগলফিয়ার ভাই দের ডিজাইন অনুসারে রেভেলন তাদের বানায় দিলেন ষাইট হাজার কিউবিক ফিট এর এক বিশাল বেলুন । বেলুন্টার কালার স্কিম আসিল নীল আর সোনালি। উপরে আসিল রাজা লুই এর রয়েল মোনগ্রাম আর বিভিন্ন জোডিয়াক (রাশিফল এর রাশি) সাইন। এই বেলুনের নাম রাখসিলেন “এরোস্টেটিক গ্লোব ” (Aerostatic Globe)
বই পত্র আর ইন্টারনেট ঘাইটা জানতে পারসি যে মানুষ বাহি বেলুন এর পাব্লিক ডেমো দেওনের আগে টেস্টিং এর লাইগা ইতিয়েন মন্টগলফিয়ার অন্তত একবার অইডা লয়া উরসিলেন। তয় তহন বেলুন ডা দড়ি দিয়া বান্দা আসিল মাটির লগে। তাই প্রথম মানুষ বাহি টিথারড (Tethered) ফ্লাইট এর ক্রেডিট টা ইতিয়েন মন্টগলফিয়ার রে দেওন যায়।
২১শে নভেম্বর ১৭৮৩। প্যারিসের পশ্চিমে শহরতলি থিকা রাজার এক সেনা অফিসার মারকুইস (marquis d’Arlandes ) আর পিলাত্রে (Pilâtre de Rozier) রে নিয়া মন্টগলফিয়ার ভাইদের হট এয়ার বেলুন “এরোস্টেটিক গ্লোব” উড্ডয়ন করল। এই বেলুন প্যারিসের ২৫ মিনিটে ৩ হাজার ফিট উপ্রে দিয়া উইরা ৯ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়া রাম্পারট সিটির বাইরে দুইটা উইন্ডমিল এর মাঝখানে সফলতার সাথে ল্যান্ড করল। পিলাত্রে আর মারকুইস দুইজনই পরে লিখা গেসেন যে প্রথম বেলুন ভ্রমন খুবি মজা হইসিল। একটা সময় বেলুনের আগুন লাইগা যাওনের অবস্থা হইসিল প্রায় কিন্তু পিলাত্রে উনার কোট দিয়া বাইরায়া আগুন নিভায়া লাইসিল।
মানুষ নিয়া হট এয়ার বেলুন এর সফল উড্ডয়ন এর ঘটনা চারিদিকে ব্যাপক সারা ফালায় দিল। আর জেকুয়েস চার্লস বুকে সাহস পাইলেন উনার হাইড্রজেন বেলুন এও মানুষ উডাইতে । তাই মণ্টগলফিয়ার ভাই দের হট এয়ার বেলুনে প্রথম ম্যানড ফ্লাইট চালানির ঠিক ১০ দিন পর মানুষ বাহি হাইড্রজেন বেলুন উড়ানির উদ্যোগ নিলেন।
১লা ডিসেম্বর, সন ১৭৮৩। ৪ লক্ষ লোক প্যারিস এ সমবেত হইলেন প্রথম মানুষ বাহি হাইড্রজেন বেলুন এর লঞ্চিং দেখনের লাইগা। এর মধ্যে একশ জন ১ ক্রাউন ( তখনকার ফ্রান্স এর মুদ্রা ) কইরা দিসেন এই প্রজেক্ট এর ফান্ডিং এর লাইগা আর কাছে থেইকা দেখার লাইগা যে ইশপেশাল এনক্লজার গ্যালারি বানানি হইসে ওই খানে বহানির লাইগা। এই এনক্লজার এ অনেক গণ্যমান্য ব্যাক্তি রা বইসিলেন। যার মধ্যে দুই জন এর নাম খুবি উল্লেখযোগ্য। একজন হইলেন পরবর্তী তে আম্রিকার প্রেসিডেন্ট বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিন আর মণ্টগলফিয়ার ভাই দের একজন জোসেফ মন্টগলফিয়ার। চার্লস লুক্টা এতই ভালা আসিল যে উনি জোসেফ মন্টগলফিয়ার রে সম্মান কইরা মুল বেলুন উড়ানির আগে যে ছোট অয়েদার বেলুন্টা উড়ানি হয় ওইটা উইড়াইতে দিসিলেন।
বেলা ১টা পয়তাল্লিশ মিনিটে জেকুয়েস চার্লস আর রবার্ট ভাই দের একজন নিকলাস লুইস রবার্ট তাদের বানানি হাইড্রজেন বেলুন নিয়া আকাশে উড়লেন। বেলুন্টা ছিল ৩৮০ কিউবিক মিটারের । ২ ঘন্টা পাঁচ মিনিট ধইরা ১৮০০ ফিট উপ্রে দিয়া উইড়া ৩৬ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়া উত্তর ফ্রান্স এর নেসেলস (Nesles-la-Vallée) শহরে নাইমা আসলেন জেকুয়েস চার্লস আর নিকলাস লুইস রবার্ট। প্রমান হইল মানূষ এখন উড়তে পারার জন্য প্রস্তুত।
আগামি পর্বে আমি এই দুই প্রকার বেলুনের আরো ডেভেলপমেন্ট আর কিভাবে সেইটা আস্তে আস্তে পেলেন এর দিকে আগাইল তা লয়া লিখুম। আজকের লেখাডা এট্টু বেশি বড় হয়া গেসে ওই জন্য দুঃখিত। কিন্তু আসা করি আমি লিখা যেরুম মজা পাইতাসি আপ্নেরা পইড়াও অইরম মজা পাইতাসেন। লেখা সম্পর্কে যে কোন মতামত পড়ের লেখা গুলা রে আরো ভাল করতে আমারে সাহায্য করবে।
এতক্ষণ কষ্ট কইরা পড়ার জন্য অনেক ধন্যবাদ। আপনাদের উড়তে শেখা শুভ হোক।
দেশটার নাম ইটালি। আর শহরটার নাম ব্রেসিয়া। শহরটা সুন্দর, আল্পস পাহাড়ের একেবারে নিচেই। দেখার মত অনেক কিছু আসে এইখানে । রোমান সভ্যতার নিদর্শন আসে, ক্যাথেড্রেল আসে, একটা দুর্গ ও আসে। আমি অবশ্য শিউর না, জীবনেও তো যাই নাই। পইড়া পইড়া জানসি খালি। তয় পেলেন পাগলা মানুষের জন্য একটা জিনিষ শিউর আসে, যেইটা হইল, এক ইটালিয়ান ব্যাডার বাড়ী। ব্যাডার নাম ফ্রেঞ্চেস্কো লানা দে তারজি (Francesco Lana de Terzi)। ইনি বিরাট বিদ্যান লুক। উনি আসিলেন এই শহরের ফিজিক্স আর ম্যাথম্যাটিকস এর প্রফেসর । ইনার গল্প দিয়াই আজকের পর্ব শুরু করতাসি কারন ইনারে বলা হয় “এরোনেটিক্স এর বাপ”।
সন ১৬৭০। জনাব ফ্রেঞ্চেস্কোর বয়স তহন ৩৯ বছর। উনি একটা বই প্রকাশ করলেন যার নাম “Prodomo” । এই বইয়ে একটা চ্যাপ্টারে উনি প্রথম “ফ্লাইং শিপ” এর ব্যাপারে লেখেন। এইটা ছিল ওটো ভন গেরিক (Otto von Guericke) এর “মাগডেবারগ গোলক” (Magdeburg hemispheres) এর উপর ভিত্তি কইরা “ফ্লাইং শিপ” এর একটা থিউরিটিকাল ধারনা। ইয়াল্লা এডি কি কন !!!! মাস…গুলক… হুয়াট ?? কিরুম পেস পুস লাইগা গেল তাই না? আইচ্চা আরেক্টু ভাইঙ্গা কই।
১৬৫৪ সালে জার্মান বৈজ্ঞানিক ওটোভন গেরিক, ভেকুয়াম পাম্প ডিজাইন করেন। এই পাম্প তো আর পেড্রোলো পাম্প না যে পানি নিয়ে ভাবনা, আর না না … বইলা পাম্প মাতায় লয়া নাচা নাচি করব। তাই এইডার কাম কাইজ দেহানির লাইগা উনি তামা দিয়া দুই পিস গুল্লা গুল্লা জিনিষ বানায়ালান। বস্তুর উপ্রে এটমস্ফেরিক চাপ বুজানির লাইগা এই দুই তামার গুল্লা গুল্লা জিনিষ আর ভেকুয়াম পাম্পটা ব্যবহার হইত।
উনি দেখাইলেন যে এই দুই গুল্লারে এক সাথ কইরা পাম্প টা দিয়া তাগো ভিত্রের বাতাস বাইর কইরা নিলে কেউ আর জিন্দিগিতে এই গুল্লা গুল্লা রে আলাদা করতে পারব না। এই গুল্লারেই তিনি নাম দিসিলেন “মাগডেবারগ গোলক”। মাগডেবারগ জার্মানির একটা শহর, এইডা আসিল ওটোভন গেরিক এর হোমটাউন।
ফ্রেঞ্চেস্কো তার “ফ্লাইং মেশিন” ডিজাইনে এই “মাগডেবারগ গোলক” ব্যবহার করলেন। তিনি একটা নৌকার মত জিনিষ তৈরি করলেন যার মাস্তুল পাঁচ টা। চাইর কুনায় চাইড্ডা আর মাঝখানে একটা। চাইর কুনার চাইট্টায় লাগাইলেন একটা কইরা “মাগডেবারগ গোলক” আর মাঝখানের টায় লাগাইলেন একটা নৌকার পাল। লাগাইলেন মানে ডিজাইনে দেহাইলেন আরকি। বাস্তবে এই “ফ্লাইং মেশিন” তিনি তৈরি কইরা যাইতে পারেন নাই, কারন তহনকার আমলে পাতলা কপার শিট তৈরি করা যাইত না। ওগো তো আর আমাগো মত ধোলাইখাল আসিল না, ওই জন্য আরকি।
যাউকগা, ফ্রেঞ্চেস্কো দে লানার “ফ্লাইং মেশিন” এর কাম করনের পদ্ধতি খুবি সিম্পল আসিল। উনি ভাবসিলেন ফাস্ট এ ওই গুল্লা গুলার ভিত্রেত্তে ভেকুয়াম পাম্প দিয়া বাতাস বাইর কইরা নিতে হইব। তাইলে বেপারটা হইব পানির তলে টেনিস বলের মত। বল্ডা যেরুম পুট কইরা উপ্রে আয়া পরে, সেরম বাতাসেও “মাগডেবারগ গোলক” গুলা উপ্রে উঠব। আর উপ্রে উঠার পর পালে বাতাস লাগ্লে “ফ্লাইং শিপ” এ বয়া মাইনষে গান গাইব “নাউ ছারিয়া দে, পাল উরাইয়া দে…”।
ফ্রেঞ্চেস্কো দে লানার আরেকটা পরিচয় অনেকেই জানে না সেইটা হইল উনি ব্রেইলির ও আগে ১৬৭০ সালেই অন্ধ দের পড়তে পারার অক্ষর সিস্টেম আবিষ্কার কইরা গেসেন। লুইস ব্রেইলি ১৮২১ সালে আইসা আরো ইম্প্রোভাইজ করসেন তার নিজের সাধনায়। কিন্তু সেই গল্প অন্য লাইনের। তাই ফিরা আসি উড়তে শেখায়।
ফ্রেঞ্চেস্কো দে লানা তার “ফ্লাইং শিপ” এর ব্যাপারে লেখাটার শেষে যে নোট যুক্ত কইরা গেসেন তা পড়লে একটা চমকায়া উঠার মত কথা পাওন যায়। উনি আসিলেন একজন Jesuit অর্থাৎ Society of Jesus নামে একটা ক্যথলিক গ্রুপ এর মেম্বার। ঈশ্বর এর সেবক হিসাবে তাই তিনি লিখা গেসেন
“God will never allow that such a machine be built…because everybody realizes that no city would be safe from raids…iron weights, fireballs and bombs could be hurled from a great height“.
আজকের দিনের সুপারসনিক ফাইটার জেট আর লং রেঞ্জ বোম্বার গুলার কথা চিন্তা করলে কোন মিল খুইজা পান কি?
আমি ভাবসিলাম আজকের পর্বেই বেলুন আবিষ্কার লয়া লিখুম কিন্তু এখন মনে হইতাসে ওইটা আল্লায় বাচাইলে ৩য় পর্বে লিখি, তাইলে হাত খুইলা লিখতারুম আর আপ্নেগো ও ইনফরমেশন অভার ফ্লো হইব না। আর আমি দি প্রাউড আইলশা, এই পর্ব শেষ করার একটা উসিলা পায়া যামু … মু হা হা ।
আশা করি এই লেখা গুলা পইড়া আপ্নেও ঠিক অতটাই মজা পাইতাসেন যতটা আমি এইগুলা নিয়া লিখতে পাইরা পাইতাসি। লেখা সম্পর্কে যে কোন মতামত পড়ের লেখা গুলা রে আরো ভাল করতে আমারে সাহায্য করবে।
এতক্ষণ কষ্ট কইরা পড়ার জন্য অনেক ধন্যবাদ। আপনাদের উড়তে শেখা শুভ হোক।
উড়তে শেখার ইচ্ছা মাইন্সের কবে থিকা হইল তা খুজতে গেলে দ্যাহা যাইব, মানুষ যেদিন থেইকা কল্পনা করতে শিখসে সেদিন থেইকাই মাইন্সের মনে হইসে, আহা এই যে পক্ষিডা উইড়া গেল মাতার উপ্রে দিয়া, এরুম যদি আম্মো উড়তে পাড়তাম তাইলে কি তামশাডাই না হইত। এই কল্পনার পিসে মানুষ দোউড়াইসে, আছাড় খাইসে, হাড্ডি গুড্ডি ভাংসে, মারা গেসে। কিন্তু তারপরো চেষ্টা কইরা গেসে। এত হাজার বছর পর, আমরা সেই সবগুলা মানুষের ক্রমাগত চেষ্টার ফসল আমাদের মাথার উপ্রে দিয়া উইড়া যাইতে দেখি আর মনে মনে ভাবি “ও পেলেন যায়? অইডা আর এত দেহার কি আসে, ওইডা তো সুইচ টিপ মারলেই উড়ে”।
কিন্তু হাজার হাজার বাধা রে পারা পুরা দিয়া আগায়া গিয়া উড়তে শিখতে সেই পেলেন পাগলা মানুষ গুলার যে কত অছাম একটা জারনির মধ্যে দিয়া যাইতে হইসে, তা খুজতে গিয়া এই লেখকের মনে হইসে , বাহ ব্যপক ইন্সপাইরেশন এর খনি পাইয়া গেলাম তো । এই মজা একা একা পাওন ঠিক না। আর এই লেখক আরো আবিষ্কার করসেন, বাংলা ভাষায় “হিস্টোরি অফ এভিয়েশন” এর উপ্রে কোন লেখা পাওয়া খুবি কডিন। তাই উনি “হুটেলের খায়া জঙ্গলের মহিষ তাড়ানি প্রকল্প” হাতে নিসেন। বাংলায় প্রথম “উড়তে শেখার ইতিহাস” লেখার উদ্যোগ নিসেন। যার প্রথম কিস্তি এইটা। সব গুলা তথ্য সূত্র লেখার শেষে দেওয়া আছে।
যাউকগা পেলেন রানওয়ে ছাইড়া আদারে বাদারে গেসেগা, তাই আবার রানওয়েতে ফেরত আহি। পৃথিবীর সব হিস্টোরি অফ ফ্লাইয়িং এর লেখায়, সিনেমায়, বই এ উড়তে শেখার কথা বলতে গেলেই একটা গ্রিক মিথোলজির কথা আসে। তাই আহেন আমরাও আর একি যাত্রায় পৃথক পথে না গিয়া অইডা কি জাইন্না লই আগে। কাহিনিডা হইল ইকারাস (Icarus ) এর কাহিনি ।
খ্রিস্টপূর্ব ১৭০০ সালের দিকে এক দেশে আসিল এক ইকারাস। তাইনের বাফের নাম ডেডালাস। তাইন গো বাড়ী গ্রীস দেশের ক্রেট শহরে। ডেডালাইস আসিলাইন কারিগর। তাইন একবার মুম দিয়া পাখির পালক জুরা লাগায়া লাগায়া নিজের আর ইকারাস এর লাইগা দুই জোড়া পাংখা বানাইলেন। এক জোড়া ইকারাস রে দিয়া কইলেন, এই ল পাংখা, হেপি ভাড্ডে। আয় আমরা এক চক্কর উইড়া আহি। আমার পিসে পিসে নাক বরাবর উড়তে থাক। তয় খবরদার সূর্যের বেশি কাসে যাইস না কইলাম। তইলে খবর আসে।
কিন্তু বিয়াদ্দপ ইকারাস উড়া উড়ি শুরু করনের লগে লগে বাপের কথা ভুইল্লা গেল। জোশের চোটে বাপের পিসে পিসে না গিয়া আরো উচায় উইড়া বেশি পাট দেহাইতে গেল। সূর্যের বেশি কাসাকাসি উড়নের কারনে তার পাঙ্খার মোম গেল গইল্যা। আর ইকারাস পপাত কইরে ধরনিতলে পইড়া গেল। পুরাই অয়ান পিস মেড, কারিগর ডেড অবস্থা।
ল্যুভ মিউজিয়াম এ “দা ফল অফ ইকারাস”
আমি ধর্মগ্রন্থে খুজার ট্রাই করসিলাম উড়তে শেখার বেপারে কি লেখা আসে। কোরআন শরিফে উড়তে শেখার ব্যাপারে কি বলা আছে আমি জানি না। তাই না জাইনা কিছু লিখতে চাই না। এখনো জানার চেশটায় আসি। জানতে পারলে অবশ্যই এইখানে যোগ কইরা দিমু। তবে খ্রিস্টপূর্ব ১০০০ সালের দিকে লিখিতহিন্দু বেদ পুরানে “পুষ্পক রথ ভিমানাস” ওরফে “বিমান” বইলা এক ধরনের ফ্লাইং মেশিন এর উল্যেখ পাওয়া যায়।
সময় বয়া যাইতে থাকে। খ্রিস্টপূর্ব ৫০০ সালের দিকে চাইনিজ রা প্রথম ঘুড়ির ব্যাবহার শুরু করে আর খ্রিস্টপূর্ব ২০০ সালের আইসা তারা আরো এক ধাপ আগায়া আবিষ্কার করে ফানুষ। তখন অইটার নাম ছিল “স্কাই ল্যান্টারন”। এইটাই মানুষের তৈরি প্রথম হট এয়ার বেলুন বইলা ধইরা নেওয়া যায়। বেলুন সম্পর্কে আমরা আরো জানতে পারব এই লেখার ২য় পর্বে। ততক্ষন আল্লায় আমারে আর আপ্নেরে বাচায়া রাখুক।
রোমের ইতিহাসেও কিছু উড়তে শেখার কাহিনীর খোজ পাওয়া যায়। রোম এর সম্রাট তখন নিরো। সময়কাল খ্রিস্টাব্দ ৬০ সাল। উনার দরবারে একবার এক ব্ল্যাক আরট জাদুকর “সাইমন দা ম্যাজিশিয়ান” আইসা বললেন উনি লেভিটেশন বিদ্যা চর্চা করেন আর উনি উড়তে পারেন। নিরো কইলেন তা বেশ তো, দেহি তো কিরুম উড়তে পারো? ওই জাদুকর উইঠ্যা গেলেন প্রাসাদের ছাদে। পুরা রোম এর লুকজন জড় হইসে প্রথম উড়তে পারা মানুষ দেখার লাইগা। সম্রাট ইশারা করতেই জাদুকর লাফ দিলেন ছাদ থিকা। আর চারপাশে তালির বন্যা বয়া গেল কারন উনি সফলতার সাথে ঠাশ কইরা মাটিতে আইসা পরসেন লাইক এ স্টোন । মারা গেলেন সাইমন দ্যা ম্যাজিশিয়ান।
পেইন্টিং টার নাম “দ্যা ডেথ অফ সাইমন”
৮৭৫ সালে স্পেন এর একজন মুসলমান কবি আব্বাস ইবনে ফিরনাস পাংখা লাগায়া গ্লাইড করনের প্রায় সফল চেস্টা করেন। যদিও তার ফ্লাইট সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে পারসি খুবি কম। শুধু এইটুকু জানতে পারসি যে উনি পালক দিয়া পাখা বানাইসিলেন, এবং বেশ কিছুদুর গ্লাইড ও করসিলেন। তিনি এই চেস্টার পর মারা যান্নাই কিন্তু মেরুদন্ডে ব্যাপক ইঞ্জুরি খাইসিলেন।
উড়তে শিখনের এই দৌড়ে পিসায়া আসিল না ইংল্যান্ড ও। ১১শ শতকের ইতিহাসে মামসবারি (Malmesbury) বইলা একটা জায়গায় এইরকম ই এক ইতিহাসের সন্ধ্যান পাওন যায়। এই হানে এলমার নামে এক পাদ্রি আসিলেন। ইনি উপড়ে যে ইকারাস আর ডেডালাস এর গল্প ডা কয়া আইলাম সেইটা মন প্রান দিয়া বিশ্বাস করতেন। উনি ঠিক করলেন, নাহ, উড়তে হইব, কি আসে দুনিয়ায়, হুয়াট ইজ আরথ। উনি নিজের দুই হাতে দুইডা হাতে বানানি পাংখা লাগাইলেন। তারপর উইঠা গেলেন মামসবেরি এবির একেবারে চুড়ায়। হা কইরা থাকা বাকি সব মঙ্ক দের সামনে ঈশ্বরের নাম কইরা দিলেন লাফ। কিন্তু আপচুশ। মাটিতে আছ্রায়া পড়লেন তিনি। পা দুইটা ভাইঙ্গা গেল আর সারা জীবনের লাইগা পঙ্গু হয়া গেলেন। কিন্তু তার এই লাফ দেওয়া কি ব্যার্থ হইসিল? আমি বলব, না। কারণ উনি তার ফ্লাইট এনালাইসিস এ লিখা গেসেন, “আমার ব্যার্থতার কারণ, আমি একটা লেজ লাগাতে ভুলে গিয়েছিলাম”। এই “ল্যাঞ্জা” যে কত দরকারি বিষয় সেইটা আমরা আস্তে আস্তে নিজেরাই দেখতে পারব, সাম্নের লেখা গুলা তে।
এলমার দি ফ্লাইং মঙ্কঃ
১২শ শতকে ইংল্যান্ডের ফিলোসফার রজার বেকন প্রথম উদ্যোগ নেন এই উড়নের ব্যাপারটা রে বৈজ্ঞানিক উপায়ে এপ্রোচ করনের। তিনিই প্রথম অরনিহপ্টার (Ornihopter) কনসেপ্ট এর বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা লিখা যান। অরনিহপ্টার হইল এমুন এক যন্ত্র যা পাখির মত পাখা নারায়া উড়তে পারে। এই অরনিহপ্টার এ মানুষ থাকতে পারে আবার নাও থাকতে পারে। রজার বেকন কয়া গেসেন “এক জুড়া পাংখা আর এত্ত গুলা আত্মবিশ্বাস উড়নের লাইগা যথেষ্ট না। তার সাথে দরকার আরো কোন শক্তি।” কিন্তু ওই সময়ের চার্চ তার এই ধারনারে ঈশ্বর বিরোধি বইলা মনে করসিল আর তারে গৃহবন্দি কইরা রাখার আদেশ দিসিল।
রজার বেকন এর স্ট্যাচুঃ
১৪শ শতকে
রেনেসা শুরু হইলে আর্ট এবং বিজ্ঞানে মানবজাতি অনেক নতুন নতুন সৃষ্টি দেখতে পায়। এই সময়ের অন্যতম লিজেন্ড লিয়োনার্দ ডা ভিঞ্চি, উড়তে শেখার এই মহা যাত্রায় সামিল হন আর অনেক গুলা কাজ কইরা যান যা মানুষ কে অনেক দূর আগায়া নিয়া যায় । লিয়োনার্দ এই সময়ে ডিজাইন করেন অরনিহপ্টার (এইডা কি খায় না মাথায় দ্যায় তা উপ্রের প্যারায় লেহা আসে, লাগ্লে আবার পইড়া লন ইট্টূ), হেলিকপ্টার এবং প্যারাশুট। এ ছাড়া তার স্টাডি নোট এ মেকানিকাল উইং আর বাতাসের ফ্লো সম্পর্কে তার পড়াশুনার স্কেচ এবং লেখা পাওয়া যায়। উনার ছাত্ররা প্রায় ই চাইত তার আঁকা ফ্লাইং মেশিন গুলা বানায়া উড়াইতে। কিন্তু উনি বারবার বইলা গেসেন “এখনও না। মানুষ এখনও পাখির মত গতিতে এই ফ্লাইং মেশিন এর পাখা নারাইতে পারবে না, তার জন্য মানুষের দরকার হবে আরো শক্তিশালি মেশিন এর”। কি বুঝলেন? উনি কিন্তু মোটরাইজড ফ্লাইট এর একটা আভাস দিয়া গেসেন সেই আমলেই। বিরাট কাবিল লুক আসিলাইন, উফফ।
লিয়োনার্দ ডা ভিঞ্চি এর ডিজাইন করা অরনিহপ্টার
১৬৮০ সালে ইটালির বিজ্ঞানি জিওভানি আলফ্রান্সো বরেলি, যারে কিনা Biomechanics এর বাপ বলা হয়, মানুষের হাত এর সাথে পাখির পাংখার একটা তুলনামুলক গবেষনা প্রকাশ করেন। ওই খানে তিনি বলেন যে মাইন্সের হাতের মাছল পাওয়ার দিয়া পাখির পাংখার সম্পরিমান নারানি জীবনেও সম্ভব না। পাখির পাঙ্খার শক্তি তার নিজের ওজনের চেয়ে ১০ হাজার গুন বেশি।
বরেলির এই আবিষ্কার দুনিয়া জুইরা মাইন্সের পাংখা লাগায়া উড়নের চেষ্টা অনেক খানি ই কমায়া দিল আর বাইচা গেল আরও অনেক গুলা প্রান।
এরপরের ইতিহাস মানুষের বাতাসের চেয়ে হাল্কা যান আবিষ্কার এর ইতিহাস। বেলুন, ফ্লাইং শিপ এর ইতিহাস। সেই বেলুন যাত্রার উড়তে শেখা নিয়া ২য় পর্বে ছবি সহ বিস্তারিত থাকবে। আশা করি এই লেখা গুলা পইড়া আপ্নেও ঠিক অতটাই মজা পাইতাসেন যতটা আমি এইগুলা নিয়া লিখতে পাইরা পাইতাসি। লেখা সম্পর্কে যে কোন মতামত পড়ের লেখা গুলা রে আরো ভাল করতে আমারে সাহায্য করবে।
এতক্ষণ কষ্ট কইরা পড়ার জন্য অনেক ধন্যবাদ। শুভ নববর্ষ।
কলম্বিয়া ডিজ্যাস্টার এর টেকনিকাল কারন গুলোর পাশাপাশি যে বড় ধরনের কিছু প্রাতিষ্ঠানিক এবং ব্যাবস্থাপনামূলক কারন ও ছিল তার গভিরে ঢোকার আগে আমাদের NASA এবং নাসার পরিচালিত বিভিন্ন প্রজেক্ট ও কার্যক্রম এর ব্যাপারে কিছু ধারনা থাকা প্রয়োজন। তাই আমি আজকের লেখায় গল্পটা আরো পেছন থেকে বলা শুরু করছি যাতে আমরা ধাপে ধাপে পুরো ব্যপার টার ব্যাপ্তি অনুধাবন করতে পারি।
১৯৫৭ সালে সোভিয়েত রাশিয়া মহাকাশে স্পেস ইতিহাসের প্রথম স্যাটেলাইট স্পুটনিক প্রেরণ করে। এর জবাবে তার পরের বছরই অর্থাৎ ১৯৫৮ সালে আমেরিকার কংগ্রেস এবং প্রেসিডেন্ট আইসেনহাওয়ার গঠন করেন National Aeronautics and Space Administration বা যাকে আমরা NASA নাম এ চিনি। এ ব্যাপারে আমেরিকা যে প্রচন্ড রকম সিরিয়াস ছিল তার ধারনা পাওয়া যায় ১৯৬০ সালে প্রেসিডেন্ট এর বিজ্ঞান বিষয়ক পরামর্শক কমিটির রিপোর্ট এ। সেখানে বলা হয় “আমরা মহাকাশ জয়ের এক দৌড়ে নেমে পড়েছি। এই দৌড়ে কেউ কেউ ভাবছেন নতুন এবং রোমাঞ্চকর বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার এর কথা যা নিশ্চিত ভাবেই হতে যাচ্ছে। কেউ কেউ ভাবছেন পরিচিত যুদ্ধক্ষেত্রের সীমানা ছাড়িয়ে মানুষকে এমন জায়গায় নিয়ে যেতে যা এতদিন ছিল কল্পনাতীত”
প্রতিষ্ঠার প্রথম দুই যুগে নাসা বেশ কিছু বড় বড় প্রজেক্ট হাতে নিয়েছিল। এই প্রোগ্রাম গুলোর মধ্যে ছিল বিভিন্ন এরোনেটিক রিসার্চ প্রজেক্ট, চাঁদে বৈজ্ঞানিক গবেষনার জন্য প্রোব পাঠানো এবং দেশের সর্বপ্রথম মানুষবাহী মহাকাশযান প্রেরণ। এ সব কিছুই আমেরিকার মানুষ দারুণ আগ্রহ নিয়ে দেখছিল।
প্রতিষ্ঠার তিন বছর এর মাথায় ১৯৬১ সালের ৫ই মে, প্রথম আমেরিকান নাগরিক হিসাবে মহাকাশ ভ্রমণ করেন এলান শেপার্ড । এটি ছিল মারকারি ক্যাপসুল এ করে ১৫ মিনিট এর একটি সাবঅর্বিটাল মিশন। পরের পাঁচ বছরে আরো কিছু মারকারি এবং জেমিনি ক্যাপসুল মানুষের স্পেস ফ্লাইট এর সক্ষমতা পরীক্ষা করতে ব্যবহার হয়। একই সাথে পরীক্ষা চালানো হয় মহাকাশে মিলিত হওয়া কিংবা ডকিং এর মত স্পেস অপারেশন এর ও।
১৯৬১ সালে প্রেসিডেন্ট কেনেডি ঘোষনা দ্যান এই যুগ শেষ হওয়ার আগেই আমেরিকা চাঁদে এস্ট্রোনাট পাঠাবে। এই স্বপ্ন সত্য হয় এপোলো প্রোগ্রাম এর ১১ তম মিশন এ যখন ১৯৬৯ সাল এর ২০ শে জুলাই নীল আর্মস্ট্রং এবং বাজ অলড্রিন চাঁদের বুকে প্রথম মানুষ হিসাবে ইতিহাসের পাতায় জায়গা করে নেন। উচ্চারিত হয় আর্মস্ট্রং এর সেই বিখ্যাত উক্তি “মানুষের জন্য ছোট এক পদক্ষেপ, মানবজাতির জন্য বিরাট এক লাফ”
এপোলো প্রজেক্ট এর খরচ ছিল মারাত্বক বেশি। মারাত্মক শব্দ ব্যবহার করার কারণ হল ২৫.৬ বিলিয়ন ডলার শুধু টাকার অংকে বেশি সে জন্য নয়। ১৯৬৭ সালে লঞ্চ প্যাড এ একটি এপোলো ক্যাপ্সুল এ আগুন ধরে যায় এবং তিন জন এস্ট্রোনাট এর সবাই ঘটনাস্থলেই মৃত্যু বরণ করেন। এই ঘটনার পরে কংগ্রেস নিয়ম করে দ্যায় যে Aerospace Safety Advisory Panel নামে একটি উচ্চ পর্যায়ের প্রতিষ্ঠান মহাকাশ এ মানুষ প্রেরণের সকল কার্যক্রম তদারকি করবে। নাসাও এই আদেশ মেনে তাদের সকল হিউম্যান স্পেস ফ্লাইট সেন্টারে অতিরিক্ত সেফটি অফিস স্থাপন করে।
২য় আরেকটি দূর্ঘটনা হতে নাসা প্রায় বেঁচে যায় এপোলো থারটিন মিশনে ১৯৭০ সালে যখন চাঁদের দিকে ধাবিত হওয়ার সময় তাদের প্রাইমারি অক্সিজেন ট্যাংক বার্স্ট করে। প্রথমে মিশন কন্ট্রোল এর লোকেরা ভেবেছিলেন হয়তো এপোলো থারটিন এর ইন্সট্রুমেন্ট কোন ভুল রিডিং দিচ্ছে। কিন্তু কিছুক্ষন পরেই বেতারে ভেসে আসে এস্ট্রোনোট জেমস লোভেল এর বার্তা “ হিউস্টন, উই হ্যাভ এ প্রব্লেম”। ফ্লাইট ডিরেক্টর জিন ক্রাঞ্জ দ্রুত তৎপর হন অবস্থার গভিরতা পরিমাপ করতে। তিনি পাগলের মত একটা সমাধান খুজতে থাকেন যেখানে মিশনের এস্ট্রোনাটদের আপাতত টিকে থাকার উপায় বের করা যায় এবং সাথে সাথে একটা টীম গঠন করতে থাকেন যারা বের করবে কিভাবে এস্ট্রোনাটদের কে নিরাপদে পৃথিবী তে ফিরিয়ে আনা যায়।
প্রথমেই ক্রাঞ্জ বের করেন এস্ট্রোনাটরা লুনার এক্সকারশন মডিউল এর ভেতর আপাতত আশ্রয় নিতে পারেন। এরপর তিনি একটি “টাইগার টীম” গঠন করেন যার সদস্য ছিল বিভিন্ন বিষয়ের এক্সপার্টরা। টাইগার টীম হলো একটি বিশেষায়িত টীম। যখন অরবিট এ থাকা কোন মিশন হঠাত বড় ধরনের কোন সমস্যার সম্মুখীন হয় তখন নাসা এবং ইউনাইটেড স্পেস এলায়েন্স এর ইঞ্জিনিয়ার দের প্রধান করে মিশন ইভালুএশন রুম (MER) ম্যানেজার এরকম টাইগার টীম গঠন করার ক্ষমতা রাখেন।
টাইগার টীম সেযাত্রা বিভিন্ন অভূতপূর্ব কিন্তু সরল সমাধান দিয়ে এপোলো থারটিন কে রক্ষা করে । এপোলো থারটিন এর এই দূর্ভাগ্যজনক যাত্রার কিছুদিন পরেই ১৯৭৫ সালে নাসা আগামী ছয় বছর এর জন্য মানুষবাহি মহাকাশ যাত্রা স্থগিত করে।
কিন্তু তাতে কি দূর্ঘটনা বন্ধ হয়েছিল? কলম্বিয়া ডিজেস্টার এর সময় কি টাইগার টীম এর মত কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয় নি? এসব প্রশ্নের উত্তর গুলো আমি ধীরে ধীরে সামনের পর্ব গুলোয় সামনে নিয়ে আসবো।
যারা স্পেস শাটল সম্পর্কে একেবারেই কিছু জানেন না তাদের এই লেখাটা পড়ার আগে এই নোট টা পড়ে দেখার জন্য অনুরোধ করছি। তাতে অনেক টার্ম যেমন স্পেস শাটল কি, অরবিটার কি ইত্যাদি ক্লিয়ার হয়ে যাবে।
দুই হাজার তিন সালের ফেব্রুয়ারীর এক তারিখ। শনিবার এর সকাল। ১৬ দিন মহাশূন্যে নির্বিঘ্নে কাটানোর পর স্পেস শাটল কলম্বিয়া এর ৭ জন ক্রু মেম্বার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন পৃথিবীতে ফিরে আসার প্রায় শেষ ধাপ “রি এন্ট্রি” স্টেজ এর। সকাল ৮.১৫ তে (ইস্টার্ন স্ট্যান্ডার্ড টাইম) পাইলট উইলিয়াম ম্যাককুল এবং কমান্ডার রিক হাসবেন্ড তাদের স্পেস শাটল এর অরবিটারকে কয়েকটা রোল দেওয়ালেন অরবিটার এর ট্র্যাজেকটরি অর্থাৎ বক্রাকার গতিপথ কে স্লো করার জন্য। সকাল ৮.৪৫ মিনিটে অরবিটারটি প্যাসেফিক মহাসাগর এর উপর দিয়ে পৃথিবীর অ্যাটমোসফিয়ার এ প্রবেশ করলো। যেভাবে ধারনা করা হয়েছিল ঠিক সেভাবেই এটমোস্ফিয়ারিক গ্যাস এর কারনে অরবিটার এর ডানার সামনের ধারগুলো গরম হতে শুরু করে যা প্রায় ২৫০০ ডিগ্রি ফারেনহাইট অর্থাৎ ১৩৭১২ ডিগ্রি সেলসিয়াস এ পৌছায়। নাসার এর চেয়েও আরো বেশি তাপমাত্রা উঠবে চিন্তা করেই স্পেস শাটল এর অরবিটার ডিজাইন করেছিল তাই এ পর্যন্ত অস্বাভাবিক কিছু ছিল না।
অরবিটার তার স্বাভাবিক গতিপথ অনুসারে নামতে নামতে আরো পূর্ব দিকে যেতে থাকে। কিন্তু বাম পাশের ডানার তাপমাত্রা পরিমাপের সেন্সরটা হঠাৎ চার্ট এর বাইরে একটা রিডিং আসার সংকেত দ্যায়। হিউসটন, টেক্সাস এর মিশন কন্ট্রোল এই অদ্ভুত রিডিং টা লক্ষ্য করে এবং সাথে সাথেই এই মিশন কমান্ডার হাসবেন্ড কে জানিয়ে দ্যায়। কমান্ডার হাসবেন্ড জবাবে কিছু একটা বলতে শুরু করেন কিন্তু তার কথা কাটা পরে যায়। সকাল ৮.৫৯ এ শাটল অরবিটার থেকে ২য় বার থেকে যোগাযোগ করা হয় কিন্তু শুধু “রজার…” পর্যন্ত বলার পর পরই মাঝপথে আবার যোগাযোগ কেটে যায়। মিশন কন্ট্রোল এবার শাটল এর বাকি সব সেনসর থেকে ফেইল করার সিগ্ন্যাল পেতে থাকে এবং সকাল ৯.০০ মিনিট এ রাডার থেকে স্পেস শাটল কলম্বিয়ার সকল সিগ্ন্যাল হারিয়ে যায়।
সকাল ৯ টা ১২ মিনিট এ মিশন কন্ট্রোল টীম এর একজন একটি ফোন কল রিসিভ করেন। যিনি ফোন করেছিলেন তিনি জানান যে টেলিভিশন এ স্পেস শাটল কলম্বিয়া টুকরো টুকরো হয়ে পৃথিবীতে পড়ার ভিডিও প্রচারিত হচ্ছে। নির্ধারিত প্রটোকল অনুসারে মিশন কন্ট্রোল টীম কন্ট্রোল রুম লক করে দ্যায় এবং সব মিশন সম্পর্কিত ডেটা আর্কাইভ করতে শুরু করে।
আগস্ট ২০০৩ এ Columbia Accident Investigation Board (CAIB) এই একসিডেন্ট এর কারণ সম্পর্কিত তাদের রিপোর্ট প্রকাশ করে। স্পেস শাটল কলম্বিয়া উৎক্ষেপণ এর পর পরই একটা ১৯ ইঞ্ছি লম্বা এবং ১১ ইঞ্ছি প্রস্থের ১.৭ পাউন্ড এর ইন্সুলেশন এর কাজে ব্যাবহৃত ফোম এর টুকরা এর অরবিটার এর বাম ডানায় আঘাত করে এবং সেখানে একটা বড় হোল তৈরি করে। অরবিটার যখন পৃথিবীতে ফেরত আসার জন্য রি এন্ট্রি করে তখন এই হোল দিয়ে প্রচন্ড গরম বাতাস অরবিটার এর ডানার ভেতর প্রবেশ করে। এতে ডানার ভেতরের স্ট্রাকচার ভেঙ্গে পরে যা প্রথমে বাম পাশের ডানা এবং এরপর পুরো অরবিটারটিকেই ভেঙ্গে ফেলে।
মজার জিনিষ হলো CAIB এর রিপোর্ট টেকনিকাল ইস্যুকে হাইলাইট করা হলেও আরেকটা অংশে এটাও হাইলাইট করা হয় কিভাবে নাসা এর ম্যানেজার দের বিভিন্ন কার্যকম এই একসিডেন্ট কে তরান্বিত করে। হাভার্ড বিজনেস রিভিউ এর ২০০৪ সাল এর এক প্রতিবেদন এর উপর ভিত্তি করে আমার লেখাটাও শুরু এখান থেকেই।
আমি একটা চাঁদ পাগল মানুষ। আমি একটা স্পেস পাগল মানুষ। আমি একটা প্লেন পাগল মানুষ। এগুলা আমার পেটে ভাত জুটায় না। কিন্তু এগুলা সম্পর্কে যা কিছু পাই আমি গোগ্রাসে গিলি। রাস্তার একটা কুকুর বা কাক যেভাবে ময়লা ঘাটে আমি সুযোগ পাইলে অইরকম ভাবে বই পত্র ইন্টারনেট ঘাটি। যদি মজাদার কিছু পাওয়া যায়। মাঝে মাঝে এত মজার জিনিষ পাই যে আবিষ্কার এর উত্তেজনায় কাপাকাপি অবস্থা হয়। আজকে এরকম একটা বিষয় নিয়া লিখতে ইচ্ছা হইল। আজকের লেখার বিষয় “The Fallen Astronaut” ।
চাঁদ এর বুকে মানুষ শুধু পায়ের ছাপ, গাড়ির চাক্কার ছাপ, লুনার মডিউল এর ছাপ ই রাইখা আসে নাই, এক টুকরা আর্ট ও রাইখা আসছে। “The Fallen Astronaut” হইল চাঁদ এর বুকে মানুষের রাইখা আসা একমাত্র পিস অফ আর্ট। ১৯৭১ সাল এর পহেলা আগস্ট, আমরা যখন আমাদের অস্তিত্বের যুদ্ধ মুক্তিযুদ্ধ নিয়া ব্যাস্ত, তখন হাজার হাজার মাইল দূরে এপোলো প্রোগ্রাম এর ৯ম মনুষ্যবাহী মিশন এপোলো-১৫ এর ক্রু রা চাঁদের বুকে রেখে দিল এলুমিনিয়াম এর তৈরী একটা ছোট ভাস্কর্য, যা বানানো হয়েছিল তখন পর্যন্ত মহাকাশ অভিযানে নিহত নভোচারী দের স্মৃতির উদ্দ্যেশে। এই ভাস্কর্য এর নাম ই হলো The Fallen Ausronaut । একই সাথে এপোলো-১৫ এর ক্রু রা একটা নাম ফলক ও রেখে আসেন যেখানে ৮ জন এস্ট্রোনট এবং ৬ জন কজমোনট (রাশিয়ার এস্ট্রোনট দের কজমোনট বলা হয়)এই মোট ১৪ জন এর নাম ছিল।
The Fallen Astronaut নিয়ে কিছু মজার কাহিনী আছে। এর আর্টিস্ট বেলজিয়ান পেইন্টার ও প্রিন্ট মেকার Paul Van Hoeydonck এর সাথে এপোলো-১৫ এর এস্ট্রোনট David Scott এর দেখা হয় একটা ডিনার পার্টি তে। সেখানেই তাদের মধ্যে কথা হয় স্কট এর একটা আইডিয়ার ব্যাপারে। স্কট ১৪ জন এর নাম সহ একটা নাম ফলক বানিয়েছিলেন চাঁদ এ নিয়ে যাওয়ার জন্য, এখন তার সাথে যোগ হলো পল এর ছোট মুর্তি টা। নাসার উপর মহল থেকে পারমিশন ম্যানেজ করে ফেললেন স্কট। আর এরপরই চাঁদে মানুষের একমাত্র শিল্প নিদর্শন The Fallen Astronaut চললো চাঁদ এর পথে।
অবশ্য অনেক পরে বেলজিয়ান এক সংবাদপত্র কে দেয়া সাক্ষাতকারে আর্টিস্ট পল বলেছিলেন যে তিনি জানতেন না তার বানানো মুর্তি ১৪ জন মৃত নভোচারীর স্মৃতির উদ্দেশ্যে বানানো হচ্ছে। তিনি এটাকে বানিয়েছিলেন পুরো মানবজাতির মহাকাশ যাত্রার প্রতীক হিসেবে। তিনি এটার রেপ্লিকা বানিজ্যিক ভাবে বিক্রিও করতে চেয়েছিলেন কিন্তু নাসার কঠোর হস্তক্ষেপে তা আর করা যায় নি। নাসা এই ব্যাপারে এতই সিক্রেসি মেইন্টেইন করেছিল যে মিশন শেষ হওয়ার পরে এক প্রেস কনফারেন্সে এই Fallen Astronaut এর কথা ঘোষণা করা হয়।
৬৩ বছর আগের ঠিক এই দিন। ২৪ শে ডিসেম্বর ১৯৫৫। North American Aerospace Defense Command (NORAD) এর কোলোরাডো স্প্রিংস অফিসের লাল টেলিফোন টা হঠাত বেজে উঠলো (তখন অবশ্য এর নাম ছিল CONAD)। সেদিন দায়িত্বে ছিলেন কর্নেল হ্যারি শ্যুপ (Colonel Harry Shoup)। এত রাতে ইমারজেন্সি ছাড়া সাধারণত ফোন আসে না । ভুরু কুঁচকে ফোন টা উঠাতেই চমকে গেলেন। ফোন যার গলা শোনা গেল সে একান্তই বাচ্চা একটা ছেলে। খুব ভদ্র গলায় অনুরোধ করছে স্যান্টা ক্লজ কে একটু ফোন টা দেয়া যাবে কিনা। অথবা স্যান্টা এখন কোথায় আছে যদি কর্নেল তাকে অনুগ্রহ করে বলেন তাহলে সে বুঝতে পারতো তার বাসায় স্যান্টা কখন আসবে। কনফিউজ কর্নেল কিছু একটা বলে ফোন টা রাখতেই কিছুক্ষন পর আবার একটা বাচ্চা মেয়ের ফোন, একই রকম জিজ্ঞাসা। এভাবে বেশ কয়েকটা ফোন আসার পর তাদের বাবা মা এর সাথে কথা বলে জানা গেল আসল কাহিনি।
২৪শে ডিসেম্বর সিয়ার্স এর একটা ডিপার্টমেন্টাল স্টোর একটা নিউজপেপার এ একটা বিজ্ঞাপন ছাপায়। সেখানে লেখা ছিল “হাই, আমি স্যান্টা বলছি, আমার সাথে কথা বলার জন্য ফোন কর এই নাম্বার এ”। দুর্ভাগ্য বশত যে নাম্বার টা ছাপার ভুলে ছাপা হয়ে যায় সেটা ছিল NORAD এর একটা নাম্বার এবং এভাবেই শুরু হয় NORAD এর ঐতিহ্যবাহি NORAD Tracks Santa প্রোগ্রাম এর।
কর্নেল হ্যারি শ্যুপ কিন্তু সেই রাতে বাচ্চাদের ধমক ধামক দিয়ে যাও যাও পড়তে বস বলেন নি। বরং তিনি তার সকল স্টাফ দের বসিয়ে দেন সব গুলো ফোন কল যাতে গুরুত্ব্যের সাথে জবাব দেয়া হয়। সেই রাতে কর্নেল এর এই অসামান্য উদ্যোগ NORAD পরিনত করে তাদের একটা ট্র্যাডিশন এ। গতবছর এর তথ্য মতে NORAD এর ভলেন্টিয়াররা দুইশ এরও বেশি এলাকা থেকে ঘন্টায় প্রায় ৪০ টা কল যা কিনা সবদিন মিলিয়ে প্রায় ৭০ হাজার ফোন কল এবং প্রায় ১২ হাজার ইমেইল এর জবাব দিয়ে থাকেন।
প্রতিবছর NORAD কর্মকর্তা, সাধারন মানুষ এমনকি সেলিব্রেটিরাও অংশ ন্যায় স্যান্টা কে করা ফোন কল এর উত্তর দেয়ার এই উৎসব এ। এর মধ্যে ২০১৬ সালে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার স্ত্রী ফার্স্ট লেডি মিশেল ওবামাও ছিলেন ফোন এর পাশে থেকে স্যান্টা কোথায় এর উত্তর দেয়ার জন্য। কারন স্যান্টা কে বাচ্চারা ফোন করে একটা স্বপ্ন নিয়ে। ভাল থাকলে, ভাল কাজ করলে তার পুরষ্কার পাওয়া যাবে এই স্বপ্ন। আর স্বপ্ন কে বাঁচিয়ে রাখতে হয়।
আমরা ছেলেরা কখনোই বুঝবো না একটা মেয়ের তার নিজের বাবা মা এর পাশে দাঁড়ানোর মত স্বাভাবিক ব্যাপারও কত টা কঠিন করে রেখেছে আমাদের সমাজ ব্যবস্থা। আমরা ছেলেরা ক্যারিয়ার চিন্তা কিভাবে করি?
পড়ালেখা করবো, পাশ করবো, চাকরি করবো, ব্যবসা করবো, ইনকাম হবে , সেখান থেকে কিছু টাকা জমাবো, সেই টাকা থেকে বাবা মা এর প্রয়োজনে পাশে দাড়াবো,
সিম্পল।
আর একটা মেয়ের জন্য এই রকম স্ট্রেইট লাইনে চিন্তা করাও হাস্যকর লাগবে তার কাছে।
পড়ালেখা করব – বিয়েটা করে ফেল, পাশ করব – পাশ তো করসই, এখন বিয়ে কর, চাকরি করব – আগে বিয়ে কর, বিয়ে করার পর চাকরি করব – শশুরবাড়ি থেকে দিতেও পারে, নাও দিতে পারে। ইনকাম করব – মেয়ে বলে অফিস ঠকাবে বেতন আর সুযোগ সুবিধায়। বেতন পাব – ছেলে মেয়ের জন্য খরচ কর, জামাই এর একাই ইনকাম এ তো এই জামানায় চলে না তাই সংসারে খরচ কর, ভাই বোন দের আবদার, ফ্রেন্ড দের আবদার রক্ষা কর।
আর শুধু টাকা পয়সার চ্যালেঞ্জ না। পারিবারিক চ্যালেঞ্জ ও সীমাহীন। অপদার্থ বড়ভাই বাবা মা এর জন্য কিছু করতে পারবেনা আবার মেয়ে বলে তাকে জায়গা টা ছেড়েও দেবে না। পরিবার এর বাইরের সবাই ভেবেই নেবে ছেলেটাই সব করে, মেয়েটার আর কি, শশুর বাড়ি তেই তো জীবন এখন।
তারপরও কোন এক ম্যাজিক দিয়ে একটা মেয়ে কিছু কিছু করে জমায় তার বাবা মার জন্য। আমি জানি না কিভাবে পারে। আমার কাছে কেমন অবিশ্বাস্য লাগে। আমি শুধু আমার বড় বোন রে দেখসি। আম্মার যখন ক্যান্সার টা প্রথম ধরা পড়ল, আমার বোন তার সারাজীবন এর জমানো টাকা, গয়না সব বিক্রি করে ফেলসে, ২য় বার কিছু ভাবে নাই। আমি হইলে হয়তো ভাবতেই ভাবতেই চিকিতসার টাইম যাইতো গা। আমার বোন প্রথমেই ফাইনেন্সিয়াল ব্যাপার টা সল্ভ করসে, তারপর ক্যান্সার কে বলসে, আসো খেলি।
আমি তার ধারে কাছেও কিছু করতে পারি নাই। আমি আর আমার বাবা মা কাউকে কখনো সামর্থের অভাবে বিদেশ নিয়ে যাইতে পারি নাই। আর ও দুই জন কে অস্ট্রেলিয়া নিসে, চিকিতসার ব্যাবস্থা করসে যখন ওর তখন কোন চাকরি ও নাই। দুলাভাই ও আর ও মাত্র পি আর নিয়া গেসে, দুইটা ছোট ছোট মেয়ে সাথে। একটা নতুন দেশের সামান্য পি এইচ ডি স্টুডেন্ট। অস্ট্রেলিয়া তেই আম্মার ক্যান্সার টা প্রথম ধরা পরে। দেশে থাকলে আমি হয়তো একটা সাধারন হাসপাতালে দিন এর পর দিন দেখায় ই যাইতাম আর আম্মা এই অসুধ অই অসুধ খাইতে খাইতেই চলে যাইত।
আমার বাবা মা তাদের প্রথম সন্তান দিয়াই স্টান্ডার্ড টা এত হাই করে ফেলসে যে আমি সারাজীবন ট্রাই করলেও সেই স্ট্রান্ডার্ড মিট করতে পারবো না। আমার একসময় খুব রাগ লাগতো কিন্তু এখন আমি চাই, মন থেকে চাই, আমার বাবা আম্মাকে সবাই মমর আম্মা, মমর আব্বা হিসাবেই চিনুক।
আমার আম্মা মারা গেছেন আজ সাত দিন হলো। এক টানা কষ্ট টা এখন বদলে গেছে হঠাৎ হঠাৎ তীব্র কষ্টে। তখন বারান্দায় বা বাথরুমে চলে যেতে হয়। কেউ বোঝার চেষ্টা করলে বলি, অজু করতে গেসিলাম তাই মুখ ভিজা। সবার সামনে কান্দা কেমন একটা ব্যাপার না? বিশেষ করে অফিসে।
কেমন জানি বিশ্বাস হয় না যে আম্মা নাই। আম্মা তো অনেক থেকে অসুস্থ ছিল, সব রান্না বান্না আমার ছোটখালা যাকে আমি মা ডাকি উনিই করতো। মার রান্না খারাপ তা না, কিন্তু মনে হইত আম্মার মত তো না। মনে হইত, এই তো কয়দিন পর আম্মা একটু চলা ফেরা করতে পারলেই আবার রান্না করবে। কিন্তু আম্মার রান্না আর কোনদিনও খাওয়া হবে না, এইটা ভাবলে কেমন ফাকা লাগে ভিতর টা।
আম্মার লাশ যখন বাসার নিচে আনি তখন মাগরিব এর নামাজ শেষ হইসে মাত্র। আত্মীয় স্বজন রা আসছেন। বাসার পরিবেশ কান্নায় কান্নায় ভারী হয়ে গেসে। আমি নিতে পারতেসিলাম না। তিনতালা থেইকা নাইমা আম্মাকে রাখা এম্বুলেন্স এর পাশে চুপচাপ দাঁড়ায় ছিলাম। কিছু বড়লোক আত্মীয় আইসা অনেক বড়লোকি কথা শুনাইল। তখন এত অবাক লাগতেসিল। এগুলা বলার কি খুব দরকার ছিল তখনই। আমি ভাবসিলাম এগুলা নিয়া লিখব না। পরে ভাবলাম, এগুলা আমাকে মনে রাখতে হবে মানূষ চিনতে। আমাকে শুনতে হইসে,
– তোমাদের বাসার রাস্তা তো চিপা, আমার গাড়ি ঢুকে না, তাই বড় রাস্তায় রেখে আসছি। বড় গাড়ি তো, এই তো গত মাসেই কিনলাম – ফ্রিজার ভ্যান পাও নাই, এম্বুলেন্স এ এসি ছেড়ে রাখসো যে? আমার শাশুড়ির জন্য তো ফ্রিজার ভ্যান এর ব্যাবস্থা করসিলাম। দাম টা বেশি পরে অবশ্য, কিন্তু ভাল জিনিষ। – তোমাদের বাসা তিনতালায়? লিফট নাই কেন? ডাক্তার আমাকে বলসে সিড়ি না ভাংতে। গত মাসে সিংগাপুর থেকে দেখায় আসলাম। – দাফন করবা কোথায়? তোমরা অবশ্য বনানী কবরস্থানে জায়গা পাবা না। আমার হাসবেন্ড আমাদের জন্য ওখানে বুকিং দিয়ে রাখসে। অনেক এক্সপেন্সিভ
আমার পৃথিবীটাকে এত নিষ্ঠুর মনে হইতেসিল তখন। কেন আমার অনেক টাকা নাই, কেন আমি আম্মাকে বিদেশ নিয়া গিয়া পৃথিবীর সবচেয়ে ভাল হাসপাতালে দেখাইতে পারি নাই এগুলা ভাবতে ভাবতে ছোট হয়ে ভাইঙ্গা যাইতেসিলাম নিজের ভিতর বার বার। আম্মাকে ফিস ফিস করে বলতেসিলাম, আম্মা মাফ করে দিয়েন আম্মা, কিছু করতে পারলাম না তোমার জন্য আম্মা।
তবু আমি ঠিক ছিলাম কারন আমার দেবদুত এর মত কিছু বন্ধু আছে যারা আম্মার খবর শোনার সাথে সাথে হাসপাতালে চলে আসছিল আর একদম দাফন পর্যন্ত সাথে ছিল। কিছু আল্লাহ প্রেরিত কাজিন আছেন, কিছু আত্মীয় আছেন যারা দাফন কোথায় হবে, গোসল কোথায় করানো হবে সব ম্যানেজ করে ফেলসেন। আমার আপনাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানানোর ভাষা নাই।
আমার আম্মা যেখানেই যেতেন চারপাশে অনেক ভালবাসা ছড়ায় রাখতেন। এপলোর যখন যে নার্স, আয়া আসতো সবাইকে উনি নাম ধরে চিনতেন। সবার দেশের বাড়ি, বাসায় কে আছে, বাচ্চা ভাল আছে তো এইরকম খোজ খবর নিতেন। আমি আর আমার বোন মজা করে বলতাম আম্মা সবার সাথে ফ্রেন্ডশিপ করে ফেলতে পারে। একটা উদাহারন দেই।
আম্মার লাশ দেখতে আসে পাশের বাসা থেকে অনেকেই আসছিলেন। দেখে চলে যাওয়ার সময় একটা কাপল আর তাদের একটা ছোট মেয়ে আমার কাছে আসলো। ছেলেটা বলল আমার সাথেই নাকি পড়তো নটরডেম কলেজ এ, গ্রুপ সিক্স এই। আমার মনে নাই কিন্তু আমাকে ওর মনে আছে। ওর স্ত্রী আমাকে বলল, ভাইয়া আপনাদের বাসার বারান্দার ঠিক উলটা পাশের বারান্দা টা আমাদের বাসার। আপনার আম্মা প্রায় ই বারান্দা দিয়ে আমার মেয়েটার সাথে কথা বলতেন। আমার মেয়েটাও বারান্দায় আপনার আম্মা কে না দেখতে নানু নানু বলে ডাক্তো। একবার কয়েকদিন ও বারান্দায় যাচ্ছিল না দেখে আপনার আম্মা আমাদের বাসায় চলে আসছিলেন ওর কিছু হলো কিনা দেখতে। আমার মেয়েটার তখন জ্বর ছিল। আপনার আম্মা ঠিক ই বুঝতে পেরেছিলেন সেটা। আমার মেয়ে তার বারান্দা নানু কে কোনদিন ভুলবে না।
আরেকদিন আম্মার কবর জিয়ারত করে বাসাবো ফিরতেসি। বাসার সামনে নামার পর রিকশাওয়ালা জিজ্ঞেস করলো, আপনার আম্মা মারা গেছেন না? আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, হ্যা, আপনে ক্যাম্নে জানেন? লোকটা বলল, আমি জানি। আমি জানাজাতেও ছিলাম। আপনার আম্মা আমাকে অনেক স্নেহ করতেন। এই যে লুংগীটা আর এই গেঞ্জিটা, আপনার আম্মার দেয়া। আমি থ হয়া দাড়ায়া থাকলাম, লোকটা রিকশা নিয়া চইলা গেল।
এই রকম ছিল আমার আম্মা। সহজ সরল, বোকা সোকা কিন্তু ভালবাসায় ভরপুর একজন মানুষ। আমার আম্মা বেচে থাকতে আমাদের শিখাইসেন কখনো কিছু নিয়া গর্ব না করতে, কারো সাথে উচা গলায় কথা না বলতে, কখনো সাক্সেস পাওয়ার পর আপ্লুত না হয়া পরের বারের জন্য প্রস্তুতি নিতে। আমি এখন ভাবি মারা যাবার আগেও আম্মা শিখায় গেছেন কিভাবে বড় বড় বিপদ মাথা ঠান্ডা রেখে মোকাবেলা করতে হয়। কিভাবে দিন এর পর দিন রোগ যন্ত্রনা সহ্য করে যা সামর্থ আছে সেই অনুযায়ী অসুখ টার বিরুদ্ধে হাল ছেড়ে না দিয়ে যুদ্ধ করতে হয়।