বুক রিভিউঃ গাভী বিত্তান্ত, আহমেদ ছফা
আহমেদ ছফার খুব বেশী বই আমি পড়িনি। “গাভী বিত্তান্ত” উনার ৪র্থ উপন্যাস যা আমি পড়ে শেষ করলাম একদম এক নিঃশ্বাসে। খুবই সহজ সরল ভাষায় লেখা গভীর এনালজিকাল একটা বই। বই টা কে যদি একটা বৃত্ত হিসাবে কল্পনা করি তাহলে তার কেন্দ্রে আছে একটা গাভী। তার সবচেয়ে কাছের গ্রহ, গাভীর মালিক বিশ্ববিদ্যালয় এর উপাচার্য আবু জুনায়েদ। তারপর ক্রমাননয়ে ঘুর্নায়মান অন্যান্য চরিত্র যেমন আবু জুনায়েদ এর স্ত্রী বেগম নুরুন্নাহার বানু, আছেন অত্যন্ত প্রভাবশালি ঠিকাদার শেখ তবারক আলী। এছাড়া আরো কিছু পার্শ চরিত্র যেমন “রসায়ন” বিভাগের সুন্দরী শিক্ষিকা দিলরুবা খানম, মাওলানা আবু তাহের, তবারক আলীর জামাতা, বুয়েটপাস সিভিল ইঞ্জিনিয়ার আবেদ হোসেন, আবু জুনায়েদ এর মেয়ে দিলু এবং রেবা। এই চরিত্র রা বিভিন্ন সময়ে বই এর পাতায় এসেছেন, তাদের ভূমিকা রেখেছেন। কিন্তু আহমেদ ছফার লেখনির অন্যতম শক্তিশালী গুন হল তিনি এসব চরিত্র কে কখনোই মূল কাহিনী এবং মূল চরিত্র দের কে ছাপিয়ে উঠতে দ্যান নি।
গাভী বিত্তান্ত শুরু করার কিছুক্ষন এর মধ্যেই বোঝা যায় এটা কোন বিশ্ববিদ্যালয়কে নিয়ে লেখা। যদিও যে কোন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় এর কথা ভাবলেই এই কাহিনী কে সুন্দর ফিট করে দেয়া যায়। ছফা এই লেখা লিখেছিলেন ডিসেম্বর ১৯৯৪ থেকে ১০ ফেব্রুয়ারী ১৯৯৫ এর মধ্যে। অর্থাৎ মাত্র দুই মাস এ ছফা লিখেছিলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রেক্ষাপটে, বিশেষত বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষক রাজনীতির প্রেক্ষাপটে রচিত বাংলা ভাষার সবচেয়ে শক্তিশালী উপন্যাস হিসেবে গণ্য গাভী বিত্তান্ত যা কিনা এই ২০২৩ সালে এসেও বাস্তবার সাথে মিলে যায় হুবহু।
আমি মনে করি “আচরণ, বিচরণ ও বচন”––এই তিন ঠিক না হলে তাকে আমরা শিক্ষক বলতে পারি না। কিন্তু বাস্তবতা হলো এখন শিক্ষকদের একটা বড় অংশের বিচরণই রাজনীতির মাঠে। অনেক শিক্ষকের আচরণ দলীয় ক্যাডারের মতো। অনেকের বচন পাড়ার মাস্তানের মতো। আমার কথা গুলো লিখতে অনেক গুলো শব্দ ব্যয় হয়ে গেলো কিন্তু আহমদ ছফা তার কালজয়ী লেখনি কি অনায়াসে এই কথাটাই বুঝিয়ে দিলেন এই লাইন গুলো দিয়ে “
“আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়টির ছিল গৌরবময় অতীত। অনেকে এই বিশ্ববিদ্যালয়টিকে গোটা দেশের আত্মার সঙ্গে তুলনা করে গর্ববোধ করতেন। অতীতের গরিমার ভার বইবার ক্ষমতা বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ের নেই।’’
এই উপন্যাসের প্রধান চরিত্র আবু জুনায়েদ নামে এক অথর্ব লোকের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি হয়ে ওঠার ট্রাজেডি বর্ণনা করতে গিয়ে ছফা লিখছেন,, “সকলের দৃষ্টির অজান্তে [বিশ্ববিদ্যালয়টিতে] একের অধিক হনন কারখানা বসেছে, কারা এন্তেজাম করে বসিয়েছেন সকলে বিশদ জানে। কিন্তু কেউ প্রকাশ করে না। ফুটন্ত গোলাপের মত তাজা টগবগে তরুণেরা শিক্ষক হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢোকার পর হনন কারখানার ধারে কাছে বাস করতে করতে নিজেরাই বুঝতে পারেন না কখন যে তারা হনন কারখানার কারিগরদের ইয়ার দোস্তে পরিণত হয়েছেন। তাই জাতির বিবেক বলে মহান শিক্ষকদের কারো কারো মুখমণ্ডলের জলছবিতে খুনি খুনি ভাটা যদি জেগে থাকে তাতে আঁতকে ওঠার কোনো কারণ নেই। “
হুমায়ুন আজাদ বলে গেছেন, ‘শিক্ষকের জীবনের থেকে চোর, চোরাচালানি, দারোগার জীবন অনেক আকর্ষণীয়। এ সমাজ শিক্ষক চায় না। চোর-চোরাচালানি-দারোগা চায়।’ ফলে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা হয়তো বুঝে গেছেন যে, শিক্ষক হয়ে বেঁচে থেকে খুব বেশি লাভ নেই। তাই তারা অন্যের লেখা চুরি করে হোক আর সহকর্মীর নাক ফাটিয়েই হোক কিংবা রাজনৈতিক লেজুড়বৃত্তি–এমন একটি জীবন তারা নিশ্চিত করতে চান, যেখানে অর্থ, সম্মান এবং ক্ষমতা সবই আছে।
বই এর রিভিউ তে কাহিনী সংক্ষেপ বলাটা আমি ঠিক মনে করি না। শুধু বই এরই এক লাইন দিয়ে কাহিনী সম্পর্কে একটি ধারনা পাওয়া যায়। ছফা লিখেছেন, “দিনে দিনে গোয়ালঘরটাই বিশ্ববিদ্যালয় এর হৃদপিন্ড হয়ে উঠলো”।
উৎসাহী পাঠক এই রিভিউ পড়ে বইটিকে বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে হা হুতাশ করা একটি বই ভেবে ভুল করতে পারেন। কিন্তু সেরকম ভাবলে এই বই এর নির্যাস যে তা ছাড়িয়ে অবসেশন, নেপোটিজম, ডিক্টেটরশিপ এবং আরো অনেক কিছু নিয়ে তা থেকে নিজেকে বঞ্চিত করতে পারেন । বইটার টাইমলাইন নিয়ে অল্প কিছু রিসার্চ করতে গিয়ে দুটো মজার তথ্য পেলাম
১) ১৯৮৬ থেকে ১৯৯০ পর্যন্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ছিলেন জৈবরসায়নের অধ্যাপক আবদুল মান্নান। ছাত্রদের গোলাগুলির মাঝখানে পড়লে ‘বিশেষ যোগ্যতায়’ নিয়োগ পাওয়া বিশ্ববিদ্যালয় উপাচার্যের গর্ভবতী গাভিটি নিহত হয়
২) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০১৮ খ্রিস্টাব্দের ১২ অক্টোবর গৃহীত ‘ঘ’ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষার ফলাফল প্রশ্ন ফাঁসের অভিযোগে বাতিল করে পুনরায় নেওয়ার দাবিতে আমরণ অনশন করছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের তৃতীয় বর্ষের এক শিক্ষার্থী। আখতার হোসেন নামের ওই ছাত্র ২০১৫-১৬ শিক্ষাবর্ষের জিয়া হলের শিক্ষার্থী। বিশ্ববিদ্যালয়ের সন্ত্রাস বিরোধী রাজু ভার্স্কযের পাদদেশে মঙ্গলবার সাড়ে ১২টা থেকে অনশন শুরু করেন তিনি। আমরণ অনশনকারী প্রতিবাদ জানাতে আহমদ ছফার গাভী বিত্তান্ত বইটি পড়েছিলেন। যে ছবি বিভিন্ন জাতীয় দৈনিক এ ছাপা হয়। পরবর্তীতে ফলাফল বাতিলকৃত এবং ১৬ই নভেম্বর ভর্তিপরীক্ষা পুনরায় গৃহীত হয়।
সবাইকে গাভী বিত্তান্ত পড়ার নিমন্ত্রন।