লেখার তারিখঃ অক্টোবর ০২, ২০১৮, ৪:০৭ পি এম
আমার আম্মা মারা গেছেন আজ সাত দিন হলো। এক টানা কষ্ট টা এখন বদলে গেছে হঠাৎ হঠাৎ তীব্র কষ্টে। তখন বারান্দায় বা বাথরুমে চলে যেতে হয়। কেউ বোঝার চেষ্টা করলে বলি, অজু করতে গেসিলাম তাই মুখ ভিজা। সবার সামনে কান্দা কেমন একটা ব্যাপার না? বিশেষ করে অফিসে।
কেমন জানি বিশ্বাস হয় না যে আম্মা নাই। আম্মা তো অনেক থেকে অসুস্থ ছিল, সব রান্না বান্না আমার ছোটখালা যাকে আমি মা ডাকি উনিই করতো। মার রান্না খারাপ তা না, কিন্তু মনে হইত আম্মার মত তো না। মনে হইত, এই তো কয়দিন পর আম্মা একটু চলা ফেরা করতে পারলেই আবার রান্না করবে। কিন্তু আম্মার রান্না আর কোনদিনও খাওয়া হবে না, এইটা ভাবলে কেমন ফাকা লাগে ভিতর টা।
আম্মার লাশ যখন বাসার নিচে আনি তখন মাগরিব এর নামাজ শেষ হইসে মাত্র। আত্মীয় স্বজন রা আসছেন। বাসার পরিবেশ কান্নায় কান্নায় ভারী হয়ে গেসে। আমি নিতে পারতেসিলাম না। তিনতালা থেইকা নাইমা আম্মাকে রাখা এম্বুলেন্স এর পাশে চুপচাপ দাঁড়ায় ছিলাম। কিছু বড়লোক আত্মীয় আইসা অনেক বড়লোকি কথা শুনাইল। তখন এত অবাক লাগতেসিল। এগুলা বলার কি খুব দরকার ছিল তখনই। আমি ভাবসিলাম এগুলা নিয়া লিখব না। পরে ভাবলাম, এগুলা আমাকে মনে রাখতে হবে মানূষ চিনতে। আমাকে শুনতে হইসে,
– তোমাদের বাসার রাস্তা তো চিপা, আমার গাড়ি ঢুকে না, তাই বড় রাস্তায় রেখে আসছি। বড় গাড়ি তো, এই তো গত মাসেই কিনলাম
– ফ্রিজার ভ্যান পাও নাই, এম্বুলেন্স এ এসি ছেড়ে রাখসো যে? আমার শাশুড়ির জন্য তো ফ্রিজার ভ্যান এর ব্যাবস্থা করসিলাম। দাম টা বেশি পরে অবশ্য, কিন্তু ভাল জিনিষ।
– তোমাদের বাসা তিনতালায়? লিফট নাই কেন? ডাক্তার আমাকে বলসে সিড়ি না ভাংতে। গত মাসে সিংগাপুর থেকে দেখায় আসলাম।
– দাফন করবা কোথায়? তোমরা অবশ্য বনানী কবরস্থানে জায়গা পাবা না। আমার হাসবেন্ড আমাদের জন্য ওখানে বুকিং দিয়ে রাখসে। অনেক এক্সপেন্সিভ
আমার পৃথিবীটাকে এত নিষ্ঠুর মনে হইতেসিল তখন। কেন আমার অনেক টাকা নাই, কেন আমি আম্মাকে বিদেশ নিয়া গিয়া পৃথিবীর সবচেয়ে ভাল হাসপাতালে দেখাইতে পারি নাই এগুলা ভাবতে ভাবতে ছোট হয়ে ভাইঙ্গা যাইতেসিলাম নিজের ভিতর বার বার। আম্মাকে ফিস ফিস করে বলতেসিলাম, আম্মা মাফ করে দিয়েন আম্মা, কিছু করতে পারলাম না তোমার জন্য আম্মা।
তবু আমি ঠিক ছিলাম কারন আমার দেবদুত এর মত কিছু বন্ধু আছে যারা আম্মার খবর শোনার সাথে সাথে হাসপাতালে চলে আসছিল আর একদম দাফন পর্যন্ত সাথে ছিল। কিছু আল্লাহ প্রেরিত কাজিন আছেন, কিছু আত্মীয় আছেন যারা দাফন কোথায় হবে, গোসল কোথায় করানো হবে সব ম্যানেজ করে ফেলসেন। আমার আপনাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানানোর ভাষা নাই।
আমার আম্মা যেখানেই যেতেন চারপাশে অনেক ভালবাসা ছড়ায় রাখতেন। এপলোর যখন যে নার্স, আয়া আসতো সবাইকে উনি নাম ধরে চিনতেন। সবার দেশের বাড়ি, বাসায় কে আছে, বাচ্চা ভাল আছে তো এইরকম খোজ খবর নিতেন। আমি আর আমার বোন মজা করে বলতাম আম্মা সবার সাথে ফ্রেন্ডশিপ করে ফেলতে পারে। একটা উদাহারন দেই।
আম্মার লাশ দেখতে আসে পাশের বাসা থেকে অনেকেই আসছিলেন। দেখে চলে যাওয়ার সময় একটা কাপল আর তাদের একটা ছোট মেয়ে আমার কাছে আসলো। ছেলেটা বলল আমার সাথেই নাকি পড়তো নটরডেম কলেজ এ, গ্রুপ সিক্স এই। আমার মনে নাই কিন্তু আমাকে ওর মনে আছে। ওর স্ত্রী আমাকে বলল, ভাইয়া আপনাদের বাসার বারান্দার ঠিক উলটা পাশের বারান্দা টা আমাদের বাসার। আপনার আম্মা প্রায় ই বারান্দা দিয়ে আমার মেয়েটার সাথে কথা বলতেন। আমার মেয়েটাও বারান্দায় আপনার আম্মা কে না দেখতে নানু নানু বলে ডাক্তো। একবার কয়েকদিন ও বারান্দায় যাচ্ছিল না দেখে আপনার আম্মা আমাদের বাসায় চলে আসছিলেন ওর কিছু হলো কিনা দেখতে। আমার মেয়েটার তখন জ্বর ছিল। আপনার আম্মা ঠিক ই বুঝতে পেরেছিলেন সেটা। আমার মেয়ে তার বারান্দা নানু কে কোনদিন ভুলবে না।
আরেকদিন আম্মার কবর জিয়ারত করে বাসাবো ফিরতেসি। বাসার সামনে নামার পর রিকশাওয়ালা জিজ্ঞেস করলো, আপনার আম্মা মারা গেছেন না? আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, হ্যা, আপনে ক্যাম্নে জানেন? লোকটা বলল, আমি জানি। আমি জানাজাতেও ছিলাম। আপনার আম্মা আমাকে অনেক স্নেহ করতেন। এই যে লুংগীটা আর এই গেঞ্জিটা, আপনার আম্মার দেয়া। আমি থ হয়া দাড়ায়া থাকলাম, লোকটা রিকশা নিয়া চইলা গেল।
এই রকম ছিল আমার আম্মা। সহজ সরল, বোকা সোকা কিন্তু ভালবাসায় ভরপুর একজন মানুষ। আমার আম্মা বেচে থাকতে আমাদের শিখাইসেন কখনো কিছু নিয়া গর্ব না করতে, কারো সাথে উচা গলায় কথা না বলতে, কখনো সাক্সেস পাওয়ার পর আপ্লুত না হয়া পরের বারের জন্য প্রস্তুতি নিতে। আমি এখন ভাবি মারা যাবার আগেও আম্মা শিখায় গেছেন কিভাবে বড় বড় বিপদ মাথা ঠান্ডা রেখে মোকাবেলা করতে হয়। কিভাবে দিন এর পর দিন রোগ যন্ত্রনা সহ্য করে যা সামর্থ আছে সেই অনুযায়ী অসুখ টার বিরুদ্ধে হাল ছেড়ে না দিয়ে যুদ্ধ করতে হয়।
আল্লাহ আমার আম্মাকে যেখানেই রাখেন যেন ভাল রাখেন, শান্তিতে রাখেন। রাব্বির হামহুমা কা’মা, রাব্বাইয়ানি সাগিরা।