১৫৭/৩৬৫

লেখার তারিখঃ আগস্ট ০৩, ২০১৫ । ১০.৩৭ পি এম

 

আমার মনে হয় কবিতা পড়ার অভ্যাস থাকা টা খুব দরকার। আমাদের দেশে ইন জেনারেল কবিতা পড়া কে দেখা হয় সাধারণত দুই ভাবে। এক, সে কবিতা পরে তারমানে সে হোপলেসলি রোমান্টিক, তার আর কাজ কাম নাই। আর দুই, ও তো আবার “কবিতা টবিতা” পরে। মানে কেউ কবিতা পড়ে শুনলে আমরা তারে হয় খুব আসমানে তুইলা দেই নাইলে হাইসা উড়ায় দেই। এইটা ঘটে আমাদের না জানা থেইকা। আমাদের ডিসিশন এ পৌঁছানোর কালাচারটা হইল, আমরা যেই জিনিশ বুঝি না সেই জিনিশ কেউ করলে হয় আমাদের পারসেপশন বলে, হয় সে পাগল, নাইলে সে ব্রিলিয়ান্ট।

কিন্তু একটা মানুষের আর্ট এর সাথে পরিচয় যদি হয় কবিতা দিয়া শুরু তাইলে তার আর পিছনে তাকানোর দরকার ই হয় না। পরবর্তিতে সে ছবি তোলা শিখুক, বা সিনেমা বানাক বা পেইন্টার হোক কবিতার স্পর্শ টা থাকেই বুকের ভিতর। কবিতার মজাটা হইল, এখানে শব্দের অরণ্যে কিছু জোনাকি পোকার মত অর্থ কবি মুঠো ভরে ছড়িয়ে দেন আনাচে কানাচে । কেউ কেউ সারা অরণ্য খুঁজে শুধু গাছ দেখে চলে আসে আর কেউ কেউ দেখে একটা দুইটা জোনাকি। অথচ কবিতা প্রেমিক জানে যে এইখানে আরো অনেক বিস্ময় অদেখাই রয়া গেল। হয়ত বিশ পচিশ বছর পর আবার কবিতা টা পড়লে আবার সেই খুঁজে পাওয়া পরিচিত জোনাকি পোকা গুলার সাথে নতুন কিছু আলো পোকা বের হয়ে আসে। ভাল কবিতার মজা টা এইখানেই।

পারিবারিক ভাবে আমাদের কবিতা পড়া কে উৎসাহিত করা হয় না যত টা ছড়া কে করা হয়। অজগর টি আসচে তেড়ে, আমটি আমি খাব পেড়ে তো এখন কেউ পড়ে না। বরং ট্যাব এ নার্সারি রাইম দেখতে দেখতে আমরা শিখতেসি কবিতা একটা ভিজুয়াল জিনিশ। কবিতার সাথে ছবি থাকতে হয়, গান থাকতে হয়।

এর সহজ বোধ্যটা হয়ত তার একটা কারণ। আরেক্টা কারণ বাবা মা যা বোঝেন না, সেইদিকে তার সন্তান কে যেতে দিবেন না এইটাই স্বাভাবিক। অনেকে ইচ্ছা করেই কবিতার দিকে নেন না সন্তান কে। কবিতা পড়ে পড়ে কবি হবে? গেল ভবিষ্যৎ গেল। এই রকম ভাবার লোকজন কম না। কিন্তু যে ইঞ্জিনিয়ার কবিতা জানে বা যে ডাক্তার এর ড্রয়ারে প্রেসক্রিপশন প্যাড এর পাশে একটা শঙ্খ ঘোষ বা আবুল হোসেন এর কবিতার বইও উঁকি মারে সে যে মানুষ হিসাবে তার পেশায় কত খানি আলাদা , আফসোস সেটা তার কলিগরা এসে বাবা মার কাছে সাক্ষী দিতে পারে না।

আমার কবিতার সাথে পরিচয় টা খুবি অদ্ভুত ভাবে। আমার মনে নাই আগে এই গল্পটা লিখসি কিনা কোথাউ। আমি তখন পড়ি নার্সারি তে। প্রথমে প্লে গ্রুপ পড়ে আসছি “সেকরেড হার্ট” স্কুল এ তারপর ভর্তি হইসি পুরানা পল্টন এর “লিটিল জুয়েলস” স্কুল এর প্লে গ্রুপ এ। নতুন স্কুল , যতদূর মনে আসে খুবি ভয়ে ভয়ে থাকতাম। এর মধ্যে স্কুল এ কি জানি এনুয়াল ফাংশন হবে। আমার আম্মা কি মনে কইরা দলগত আবৃত্তি তে আমার নাম দিয়া দিল । একটা মিস ছিল নাম ভুইলা গেসি, উনি আরো বেশি উৎসাহী ছিলেন। শুধু স্টেজ এ উইঠা একটা কবিতা দেইখা দেইখা পইড়া চইলা আসলে হবে না, মুখস্ত বলতে হবে, আবৃত্তি করতে হবে, এক্সপ্রেশন দিতে হবে। আমি তখনো রিডিং ই পড়তে পারি না ভাল মত। শুরু হইল এক সপ্তাহ ব্যাপী আমাদের কবিতা মুখস্ত করার ট্রেনিং। আম্মা পড়তো, আমি শুনতাম। তারপর বলতে হইত । সব মুখে মুখে। ক্লাস এর সবার মধ্যে থেইকা ৫ জন কে চূড়ান্ত বাছাই করা হইল। আমাদের এক সাথে কোরাসে পুরা কবিতা টা স্কুল এর অনুষ্ঠানে সবার সামনে পড়তে হবে।

মনে হইতে পারে নার্সারির পুলাপান আর কি কবিতা পড়ব। ৫ জন মিল্লা টুইংকেল টুইংকেল বইলা কিছুখখন আদেখলাপনা কইরা আইসা পড়ব টাইপ হয়তো। কিন্তু না। আমার মুখস্ত করতে হইসিল, সুকুমার রায় এর “ভাল রে ভাল” (http://lib.pmo.gov.bd/s-pustak/Sukumar-roy/abol-tabol/valore-valo.html)। একটা ২৪ লাইন এর কবিতা। এমন সব শব্দ দেওয়া যা কঠিন তো পরের ব্যাপার, শুনিই নাই কোনদিন। তারপরও কেমনে মুখস্ত করসিলাম জানিনা। অনুষ্ঠান এর দিন ৫ জন এর মধ্যে ১ জন আসল না। চার জন উঠলাম স্টেজ এ। একজন ডরে দাঁড়ায় দাঁড়ায় ওই খানেই মুইত্যা দিল, আমি দেখলাম খাকি হাফপ্যান্ট এর একটা দিক হঠাৎ গাড় হয়া গেল আর সেই ধারা মোজা টপকায়ে স্টেজ এর কার্পেট দখল কইরা নিল দ্রুত।

একজন উইঠাই এত মানুষ দেইখা আম্মু আম্মু বাসায় যাবো বইলা কান্দা শুরু কইরা দিল, তারে আইসা আমাদেরর ক্লাস টিচার কোলে কইরা নিয়া গেল।

আর একজন পুরা কবিতা ভুইলা গিয়া মনের আনন্দে মাইক্রোফোন চাটা শুরু কইরা দিল।

আমার শুধু মনে আছে, স্টেজে উঠার পর আমি এত উঁচা স্টেজ এ জীবনে প্রথমবার দাঁড়াইয়া আবিষ্কার করসিলাম মাঠ এর ওই পাশে একটা দোলনা আছে যেদিক আমি যাই নাই কোনদিন। আমি লাল রঙ এর শিকলের দোলনাটার দিকে মুগ্ধ হয়া তাকায় তাকায় পুরা কবিতা একলা বইলা শেষ করসিলাম। অনেক তালি হইসিল সেদিন। আর স্টেজ থেইকা সবাইরে বাউ কইরা নাইমা আসার পর আম্মা জরায় ধরসিল। আর বলসিল, এইত্তো আমার ইথার। আমি জানতাম তো।

আম্মা যে কি জানতো, আমি ই জানলাম না এখনো।

 

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *