৭৫/৩৬৫

লেখার তারিখঃ মে ১৩, ২০১৫ । ১১.৪৪ পি.এম

“কিলো ফ্লাইট” নিয়া লেখা কন্টিনিউজ। আগের লেখায় বলসি কিভাবে বাংলাদেশ বিমান বাহিনী আর কিলো ফ্লাইট এর অফিসিয়াল যাত্রা শুরু হইল। এই টাও বলা হইসে যে কিলো ফ্লাইট এর তিনটা এয়ারক্র্যাফট এর একটাও যুদ্ধ বিমান ছিল না। সব ই ছিল বেসামরিক বিমান যেগুলা ইভেন যুদ্ধের জন্য ডিজাইন্ড ও ছিল না। কিন্তু আমরা তাতে হাত পা গুটাইয়া বইসা থাকি নাই।

“কিলো ফ্লাইট” এর অধিনায়ক করা হয় স্কোয়াড্রন লিডার সুলতান মাহমুদ কে। এই লোক টা একটা বেশি জোস লোক। মুক্তিযুদ্ধের আগে তিনি পাকিস্তান এয়ারফোরস এ ছিলেন। তার বেজ ছিল করাচীর একটু দূরে মাসরুর, মৌরিপুর এ । যখন যুদ্ধের মেঘ জমা হচ্ছিল পূর্ব পাকিস্তান এর আকাশে তখন উনি আগেই বুঝতে পারেন যে দেশ এর জন্য তাকে দরকার। ৮ই মার্চ তিনি কর্মস্থল থেইকা ছুটি নিয়া শ্রীলঙ্কা হয়া ঢাকা চইলা আসেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হইলে স্কোয়াড্রন লিডার সুলতান মাহমুদ ২ নম্বর সেক্টরে সরাসরি যুদ্ধে যোগ দেন। পরে উনাকে হাই কমান্ড থেইকা ১ নম্বর সেক্টর এ দেয়া হয়। ১ নম্বর সেক্টর এ সম্মুখ যুদ্ধে তিনি অনেক গুলা অপারেশন এ যোগ দেন। তার মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখ যোগ্য হইল তিনি কাপ্তাই এর মদনাঘাট বিদ্যুৎ কেন্দ্র উড়ায় দেন এবং তাতে পুরা চট্টগ্রাম এর বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ হয়া গেসিল। এই অপারেশন এর সময় তার পায়ে গুলি লাগে। তারপরও বাংলাদেশ বিমান বাহিনী গঠন হইসে খবর পায়া তিনি রউনা দেন ডিমাপুর এর দিকে। ১৪ই অক্টোবর ডিমাপুরে তিনি অফিসিয়ালি “কিলো ফ্লাইট” এর দায়িত্ব গ্রহণ করেন।

এই রকম একজন ইন্সপায়ারিং অফিসার ইন কমান্ড পায়া সবার মধ্যে বিপুল উৎসাহ উদ্দীপনা আইসা পরে। ডিমাপুরে বিমান সেনা দের শুরু হয় ঘাম ঝরানো ট্রেইনিং। এই টা শুরু হইত প্রতিদিন সূর্য ওঠার আগে ৪ মাইল দৌড় আর এক্সারসাইজ এর মাধ্যমে। একি সাথে চলতে থাকে কিলো ফ্লাইট এর বিমান তিনটা কে যুদ্ধের জন্য কাস্টোমাইজ করার কাজ।

Dc-3 Dakota বিমানে একটাই দরজা থাকে পিছনে। এইটারে খুইলা ফালানো হয়। বিমানের ভিতরে মোট ১০০০ পাউন্ড ওজনের বোমা ক্যারি করার জন্য সেলফ বা র‍্যাক লাগানো হয়। দরজার সামনে দুইটা স্টিল এর পাত দিয়া বোম্ব বে বানানো হয়। এমন ভাবে লাগানো হইসিল যাতে এই পাত এর উপরে বোমা রাখলে গড়ায়া সামনে গিয়া দরজার বাইরে চইলা যাবে। পুরাই বাংলা নিয়মে DC-3 Dakota এর মত পরিবহন বিমান টাকে বোম্বার বানায় ফেলা হয়। উদ্দ্যেশ্য ছিল ঢাকা এয়ারপোরট এ বোমা ফেলা।

DHC-3 Otter বিমান আর Alouette-III হেলিকপ্টারে লাগানো হয় রকেট পড। এই জন্য Otter টার ডানার নিচে আর Alouette টার দুই পাশে স্টিলের স্ট্রাকচার বা Truss বানায়া এক এক পাশে ৭ টা কইরা মোট ১৪ টা রকেট বহন করার ব্যাবস্থা করা হয়। এই রকেট গুলা ছিল ফ্রান্সের তৈরি ৫৭ মি. মি. MATRA । DHC-3 Otter বিমান আর Alouette-III হেলিকপ্টার দুইটার সামনেই টার্গেট সেট করার জন্য ছোট বৃত্তের মধ্যে + চিনহ ওলা জিনিষ টা যারে বলে Aiming Site লাগানো হয়। ৩৬০ ডিগ্রি ঘুইরা গুলী করতে পারে এমন একটা কইরা কইরা মেশিন গান লাগানো হয় DHC-3 Otter বিমান আর Alouette-III হেলিকপ্টারে। অপারেশন চলাকালীন সময় গোলাগুলি তো হবেই। তাই Alouette-III হেলিকপ্টারে পাইলট দের পায়ের নিচে ১ ইঞ্চি পুরু স্টিলের প্লেট বিছানো হয়।

বিমান তিনটার জন্য ভারতের পক্ষ থেইকা তিন জন ইন্সট্রাক্টর পাইলট দেয়া হয়। এদের অবদান বাংলাদেশ সারা জীবন শ্রদ্ধা নিয়া স্মরণ করবে। ইনারা ছিলেন,

১। DC-3 Dakota এর জন্য: স্কোয়াড্রন লীডার সঞ্জয় কুমার চৌধুরী
২। DHC-3 Otter এর জন্য ফ্লাইট লেফটেনেন্ট ঘোষাল
৩। Alouette-III হেলিকপ্টারের এর জন্য ফ্লাইট লেফটেনেন্ট কে সি সিংলা।

ইনাদের মধ্যে সঞ্জয় কুমার চৌধুরীর কথা বিশেষ ভাবে স্মরণীয়। তিনি শুধু ইন্সট্রাক্টর পাইলট হিসবে দায়িত্ব পালন কইরাই থাইমা যান নাই। কখনো ওটার বিমানের মেশিন গানার হিসাবে কখনো হেলিকপ্টারে আইসা মুক্তিযোদ্ধা দের সাথে সরাসরি সম্মুখ যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করেন।

ডিমাপুর এর পাহাড় আর জঙ্গলের মধ্যে শুরু হয় ফ্লাইং ট্রেইনিং। কখনো পাহাড়ের উপর গাছ কাইটা পরিষ্কার কইরা, কখনো গাছের উপর প্যারাসুট বিছায়া টার্গেট বানানো হয়। রাডার কে ফাকি দেওয়ার জন্য অনেক লো তে ফ্লাই করার ট্রেনিং নিতে হইতেসিল আমাদের পাইলট দের। দেশে তখন মুক্তিযুদ্ধ চলতাসে পুরা দমে। দিনে রাতে কখন অপারেশন চালাইতে হয় ঠিক নাই। তাই পাইলট দের কে নাইট ফ্লাইং এর ট্রেনিং ও নিতে হইতাসিল।

এই ভাবে দিন রাত এক কইরা ভারতীয় ইন্সট্রাক্টর, বিমান, ফুয়েল, গোলা বারুদ ইত্যাদির সহযোগিতায় বাংলাদেশ এর পাইলট রা আকাশ পথে দেশ মা কে মুক্তো করার প্রশিক্ষণ নিতে থাকেন। আগায়া আস্তে থাকে চূড়ান্ত অভিযান গুলা শুরু করার দিন। সেই কাহিনী যে কত এক্সাইটিং, আমি হয়ত আমার দুর্বল লেখা দিয়া পুরাপুরি বুঝাইতে পারবো না।

তবু, আমি মনে করি, আমাদের যা জানানো হয় নাই, জানতে দেয়া হয় নাই, আমাদের দায়িত্ব সেইটা পরের জেনারশন কে জানায় যাওয়া। আমার জন্য একটু দুয়া কইরেন যাতে এই ইতিহাস গুলা লিখা যাইতে পারি ঠিকমত। কেউ না কেউ তো পড়বেই। আগামী লেখায় কিলোফ্লাইট এর অপারেশন নিয়া লেখার ইচ্ছা রাখি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *