৭৪/৩৬৫

লেখার তারিখঃ মে ১২, ২০১৫ । ৯.৫২ পি.এম

আজকের লেখা টা একটু বড়, কিন্তু বিষয় টা আরো বেশি বড়। আগের একটা লেখায় আমি ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময় কিভাবে বাংলাদেশ বিমান বাহিনী গঠনের প্রসেস টা শুরু হইসিল সেইটা নিয়া লিখসিলাম। আজকে লিখতে বসছি কেমনে বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর অফিসিয়াল ডিক্লেয়ারশন হইল আর বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর প্রথম ইউনিট “কিলো ফ্লাইট” নিয়া। “কিলো ফ্লাইট” মুক্তি যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করে আকাশ পথে। আমি জানি না এই এত গর্বের এত এক্সাইটিং সব ডিটেইল ক্যান একদম জনগণ লেভেলে জানানো হয় নাই। আজকের সকল তথ্যের সূত্র মেজর কামরুল হাসান ভুইয়া , সেন্টার ফর বাংলাদেশ লিবারেশন ওয়ার স্টাডিজ, বাড়ী# ৪৪৮/এ , রোড# ৭ (পূর্ব), বারিধারা ডি ও এইচ এস, ঢাকা – ১২০৬

আগের লেখাটায় আমি বলসিলাম কিভাবে ভারতীয় বিমান বাহিনীর কাছ থেইকা বিমান সংগ্রহের চেষ্টা চালাইতেসিল বাংলাদেশ। অনেক দেন দরবার আর কূটনৈতিক কলা কৌশল, পারিবারিক চাপ প্রয়োগ ইত্যাদির পর ভারতীয় বিমান বাহিনীর পক্ষ থেকে বাংলাদেশ বিমান বাহিনী গঠনের জন্য দুইটা প্লেন আর একটা হেলিকপ্টার উপহার হিসাবে দেওয়া হয়। এগুলা হইল,

ফিক্সড উইং এয়ারক্র্যাফটঃ
১। আমেরিকার MacDonnell Doglas এর তৈরি DC-3 Dacota
২। কানাডার de Havilland এর তৈরি DHC-3 Otter
আর
রোটারি উইং এয়ারক্র্যাফটঃ
৩। ফ্রান্স এর Alouette-III হেলিকপ্টার।

মজার জিনিশ হইলে উনারে তিনটা বিমান দিসেন বইলা ভাব সাব নিলেও ১ নম্বর এ যেইটা লিখসি সেইটা ভারতীয় বিমান বাহিনীর বিমান ই ছিল না। একটু ঘাটাঘাটি কইরা পাইসি DC-3 Dacota টা ছিল যোধপুর এর মহারাজার ব্যক্তিগত বিমান। উনি বাংলাদেশ কে বিমান টা উপহার দিতে চাইসিলেন। কিন্তু আইনগত জটিলতার কারনে বিমান বাহিনীর মাধ্যমে দিসিলেন। ভারতীয় বিমান বাহিনী এতই বিমান যে অন্যের বিমান নিজেদের নাম এ চালায় দিয়া শুধু মহান ই হন নাই, “কিলো ফ্লাইট” এর প্রথম অপারেশন এর জন্য যখন প্ল্যানিং শেষ , হাড় ভাঙ্গা খাটুনি দিয়া বিমান গুলা কে কাস্টমাইজ করা শেষ , ঠিক এমন সময় , অপারেশন এর আগের দিন ভারতীয় বিমান বাহিনীর পক্ষ থেইকা বলা হয় ডাকোটা বিমান দিয়া কোন অপারেশন চালানো যাবে না। এইটা শুধু ট্রান্সপোর্ট বিমান হিসাবে ব্যাবহার করা যাবে। এই ঘটনা পরের লেখায় বিস্তারিত বলা হবে। আপাতত মুল গল্পে ফেরত যাই।

সেপ্টেম্বর ১৯৭১। এই বিমান তিনটা কে নাগাল্যান্ডের ডিমাপুর এ ২য় বিশ্বযুদ্ধে ব্যাবহরিত একটা পরিত্যাক্ত এয়ার স্ট্রিপ এ নিয়া যাওয়া হয়। এই খানে অবকাঠামো বলতে কিছুই ছিল না। ৫০০০ ফিট এর একটা রানওয়ে ছিল (টু কম্পেয়ার, আজকের ঢাকা এয়ারপোর্ট এর রানওয়ে ১০৫০০ ফিট) আর রানয়ের পাশে একটা দোতলা কাঠের ঘর ছিল। ব্যাস এই। কোন রাডার, রানওয়ে লাইট, এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোল টাওয়ার ইত্যাদি কিছুই নাই। পাইলট দের মনে মনে আল্লাহ মেহেরবান বইলা সুরা পরতে পরতে নিজ দায়িত্তে টেকঅফ আর ল্যান্ডিং করা ছাড়া আর কোন উপায় ছিল না। তবু আমরা মাইনা নিসিলাম। মা কে স্বাধীন করতে হবে যে।

একটু চিন্তা করেন, আজকে আশে পাশে একটা ভূমিকম্প হইলে আমরা এই বিমান বাহিনী দিয়া ত্রাণ পাঠাই। বিদেশের বিমান পেটের ভিতর কইরা আমাদের বিমান বাহিনীর জন্য হেলিকাপ্টার নিয়া আসে। ভিক্ষা পাওয়া হেলিকাপ্টার না, নগদ টাকায় কিনা হেলিকপ্টার, শান্তি মিশনে কাজ কইরা পাওয়া হেলিকপ্টার। দেশ যে আগাইসে এইটা ফিল করাও জরুরি কিন্তু।

যাই হোক, বিমান তো পাওয়া গেল। এখন পাইলট? আর ক্রু? আর এয়ারক্রাফট ইঞ্জিনিয়ার? এগুলাও তো লাগবে। কিন্তু চারপাশে তখন পাকিস্তানী চর। কোন মতে যদি পাকিস্তান জানতে পারে যে বাংলাদেশ বিমান বাহিনী গঠন করতে যাইতাসে তাইলে তারা স্যাবোটাজ চালাবেই। কে না জানে পাকিস্তানী গুলার ঘরে ঘরে বোমা বানানির কুটির শিল্প আছে।

২৪ শে সেপ্টেম্বর,১৯৭১। গ্রুপ ক্যাপ্টেন আব্দুল করিম খন্দকার এর নির্দেশে ফ্লাইং অফিসার বদরুল আলম কলকাতা থেইকা আগরতলা আসেন পাইলট, ক্রু, ইঞ্জিনিয়ার, গ্রাউন্ড স্টাফ, এটিসি এগুলা সংগ্রহ করার জন্য।

২৬ শে সেপ্টেম্বর,১৯৭১। মাত্র ২ দিন এ চরম গোপনীয় তায় রাত দিন খাটা খাটনি কইরা তিনি ক্যাপ্টেন শরফুদ্দিন আহমেদ, ক্যাপ্টেন আব্দুল মুকিত এবং ৫৭ জন বিমান সেনা সহ ডিমাপুর বেজ এ ফেরত আসেন। তখন এরা জানতেন না বিমান বাহিনীর কথা। জানতেন যে কিছু একটা হচ্ছে, দেশের জন্য।

২৭ শে সেপ্টেম্বর , ১৯৭১। গ্রুপ ক্যাপ্টেন আব্দুল করিম খন্দকার এবং ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট শামসুল আলম কলকাতা থেইকা ডিমাপুর বেজ এ আসেন। তখন ই সবাই জানতে পারেন যে পরের দিন বাংলাদেশ বিমান বাহিনী গঠিত হইতে যাইতাসে। আর সেইটা এই খানে , ডিমাপুর বেজ এই।

২৮ শে সেপ্টেম্বর, ১৯৭১। সকাল ১১ টায় এক্টা DC-3 তে কইরা ডিমাপুরে আসেন ভারতীয় বিমান বাহিনী প্রধান এয়ার চিফ মার্শাল “পিসি লাল”, এয়ার অফিসার কমান্ডিং ইন চিফ ইস্টার্ন এয়ার কমান্ড মার্শাল “হরি চান্দ দেওয়ান”, জোড়াসাঁকোর ঘাঁটির স্টেশন কমান্ডার গ্রুপ ক্যাপ্টেন “চন্দন সিং”। ভারতীয় এয়ার চিফ কে একটা ছোট গার্ড অফ অনার দ্যায় বাংলাদেশ এর বিমান সেনা রা। গ্রুপ ক্যাপ্টেন আব্দুল করিম খন্দকার এক সংক্ষিপ্ত ভাষণে বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দ্যান। বাংলাদেশ সরকার এর পক্ষ থেকে গ্রুপ ক্যাপ্টেন আব্দুল করিম খন্দকার কে বিমান বাহিনীর প্রধান হিসাবে নিযুক্তি দেয়া হয়। ভারতের ডিমাপুরে উড়ল বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর প্রথম পতাকা।

বিমান বাহিনীর গঠনের পর এইবার কাজ আসে ইউনিট গঠনের। একটা বিমান বাহিনী তে বিভিন্ন ধরনের ইউনিট থাকে। ফাইটার ইউনিট, রাডার ইউনিট, রিকনিসেন্স ইউনিট, বোম্বার ইউনিট ইত্যাদি। আমাদের যেহেতু বিমান ই ছিল মাত্র তিনটা তাই খুব বেশি বিলাসিতা করার সুযোগ ছিল না। প্রত্যেক বিমান এর জন্য ৩ জন কইরা মোট ৯ জন পাইলট ঠিক করা হয়। এই ৯ জন পাইলট আর ৩ টা বিমান নিয়া গঠিত হয় বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর প্রথম ইউনিট “কিলো ফ্লাইট”।

নাম টা “কিলো ফ্লাইট” হইল ক্যান এইটা একটু ব্যাখ্যা করি। এইটা মনে হয় সবাই জানে যে মুক্তিযুদ্ধে স্থল বাহিনী গুলার নাম দেওয়া হইসিল তাদের অধিনায়ক এর নাম অনুসারে । যেমন লেফটেনেন্ট কর্নেল জিয়াউর রহমান এর জেড ফোরস, লেফটেনেন্ট কর্নেল কাজী মোহাম্মদ শফীউল্লাহর এস ফোরস, লেফটেনেন্ট কর্নেল খালেদ মোশাররফ এর কে ফোরস এই রকম। তো বিমান বাহিনীর ইউনিট এরও এরকম একটা নাম দেওয়া দরকার ছিল। যেহেতু বিমান বাহিনী প্রধান এর নাম আব্দুল করিম খন্দকার তাই খন্দকার এর প্রথম অক্ষর K কে বাইছা নেওয়া হয়। এভিয়েশন এ এই অক্ষর গুলা কে উচ্চারণ করার জন্য একটা নিয়ম আসে। যেমন a কে বলা হয় আলফা, c কে চার্লি, M কে মাইক, J কে জুলিয়েট এরকম একদম z পর্যন্ত (আল্লাহর রহমতে প্লেন এর রেজিস্ট্রেশন এমনে মনে রাখতে রাখতে আমার এক্কেরে A থিকা z পুরাডা মুখস্ত হয়া গেসে) । এই নিয়মে K কে বুঝানোর জন্য বলা হয় কিলো। সেইখান থেইকা নাম হইসে “কিলো ফ্লাইট”।

কিলো ফ্লাইট এর ৯ জন পাইলট এর মধ্যে ৬ জন ই ছিলেন বেসামরিক পাইলট আর ৩ জন প্রাক্তন পাকিস্তান বিমান বাহিনীর। এই ৬ জন বেসামরিক পাইলট এর মধ্যে ৪ জন এক্স পি.আই.এ (পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইন্স) পাইলট, একজন বিমান থিকা ক্রপ ডাস্টিং করত অর্থাৎ ওষুধ দিত এরকম পাইলট (ইয়েস, আই রিমেম্বার ডাস্টি ফ্রম দা মুভি প্লেন্স) আর একজন ওষুধ কোম্পানি “সিবা গেইগী” ( এইট্টিজ এর কিডজ ইউল নো, সিবা গেইগি কি জিনিশ, বিষণ্ণতা একটি রোগ এর বিজ্ঞাপন দেখাইত যে কোম্পানি, সেই সিবা গেইগি) ।

কিলো ফ্লাইট এর ৯ জন পাইলট এর নাম আর তাদের কারা কোন বিমানে ছিলেন সেইটাও যোগাড় করসি। ছবিও যোগাড় করসি/করতাসি কিছু। ইনাদের নাম গুলা দিয়া আজকের লেখা শেষ করি

Alouette-III হেলিকপ্টার
১। স্কোয়াড্রন লিডার সুলতান মাহমুদ (প্রাক্তন পাকিস্তান এয়ার ফোরস)
২। ক্যাপ্টেন সাহাবুদ্দিন আহমেদ (প্রাক্তন পি আই এ)
৩। ফ্লাইং অফিসার বদরুল আলম (প্রাক্তন পাকিস্তান এয়ার ফোরস)

DHC-3 Otter বিমান
১। ফ্লাইট লেফটেনেন্ট শামসুল আলম (প্রাক্তন পাকিস্তান এয়ার ফোরস)
২। ক্যাপ্টেন আকরাম আহমেদ (প্ল্যান্ট প্রোটেকশন ডিপারটমেন্ট)
৩। ক্যাপ্টেন শরফুদ্দিন আহমেদ (ওষুধ কোম্পানি সিবা গেইগির পাইলট)

DC-3 Dakota বিমান
১। ক্যাপ্টেন আব্দুল খালেক (প্রাক্তন পি আই এ)
২। ক্যাপ্টেন আব্দুল মুকিত (প্রাক্তন পি আই এ)
৩। ক্যাপ্টেন কাজী আব্দুস সাত্তার (প্রাক্তন পি আই এ)

আগামী লেখায় কিভাবে এই বিমান গুলাকে যুদ্ধ বিমানে কাস্টমাইজ করা হইল আর আমাদের বৈমানিক দের যুদ্ধে পাঠানোর প্রস্তুতি নেয়া হইতাসিল তা লেখার ইচ্ছা রাখি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *