লেখার তারিখঃ মে ৭, ২০১৫ । ১১.৪৯ পি.এম
আগের লেখার সিকুয়েল বলা যাইতে পারে এইটারে। বলসিলাম মুক্তিযুদ্ধের দুই জন অগীত (unsung), অজ্ঞ্যাত বীর এর গল্প বলব। এদের নিয়া পড়তে পড়তে ভাবতাসিলাম এরকম যদি প্রত্যেক্টা অন ফিল্ড, অফ ফিল্ড মুক্তিযোদ্ধার কাহিনী সংকলন করা যাইতো, তাইলে আমাদের জন্য ইন্সপাইরেশন এর কত বড় এক্টা ভান্ডার হইত সেইটা।
আগের কিছু লেখায় আমি ব্যাখ্যা করসিলাম যে কেন পাকিস্তান এর বিমান গুলিকে ভারতের উপর দিয়া না আইসা কলম্বো হয়া আস্তে হইত। এই দীর্ঘ আকাশ পথে পশ্চিম পাকিস্তান থেইকা পূর্ব পাকিস্তানে সৈন্য আনার কাজ টাকে পাকিস্তান সেনাবাহিনী এক্টা অপারেশন আকারে বিবেচনা করে যার নাম ছিল অপারেশন গ্রেট ফ্লাই ইন Operation Great Fly In.
Operation Great Fly In এ শুধু সামরিক বিমান ব্যাবহার করা হইত তা না। পাকিস্তানের ন্যাশনাল এয়ারলাইন্স পি আই এর বিমান গুলাতে যাত্রি বেশে সৈন্য দের নিয়া আসা হইত যাতে কেউ বুঝতে না পারে কিন্তু প্লেন স্পটার এর চোখ রে ফাকি দিতে পারে নাই। ততকালিন মার্কিন রাষ্ট্রদূত এবং প্লেন স্পটার আর্চার কে ব্লাড এর রিপোর্ট এ তেজগাও বিমান বন্দরে এই সৈন্য আসার ততপরতার খবর উল্লেখ পাওয়া যায়। এই সব ই আগের লেখা গুলায় বলা হইসে।
২৫ শে মার্চ এর গণহত্যার পর আবার Operation Great Fly In শুরু হয়। শুরু হয় পশ্চিম পাকিস্তান থেকে সৈন্য আনা। পি আই এর একজন বাংগালি ক্যাপ্টেন ছিলেন। উনার নাম নিজাম আহমেদ চৌধুরি। তিনি যে বিমানটা চালাইতেন সেইটা এক্টা Boeing 707. তার এক্টা রেগুলার ফ্লাইট ছিল করাচি টু ঢাকা। ফ্লাই করার আগে রেগুলার প্রসিডিউর অনুসারে ক্যাপ্টেন একবার লোড শিট এ চোখ বুলান। লোডশিট এ লেখা থাকে যাত্রি সংখ্যা, লাগেজ, ফুয়েল ইত্যাদির হিসাব।
সেদিনের লোড শিট দেখে ক্যাপ্টেন নিজাম আহমেদ চৌধুরির সন্দেহ হয়। এত যাত্রি তো করাচি টু ঢাকা যায় না ঈদ ছাড়া। একবার যাত্রি দের নিজ চোখে দেখে এসে তিনি বুঝে গেলেন এরা সাধারন যাত্রি না। প্রত্যেক্টা মানুষ মিলিটারি সদস্য। তার কেবিন ক্রু রাও ভয়ে আধমরা হয়ে ছিল। কিন্তু কিছু করার সাহস ছিল না কারো।
ক্যাপ্টেন নিজাম আহমেদ চৌধুরি এবার এমন কিছু করলেন যা তাকে এক ধাক্কায় একজন পাইলট থেকে একজন মুক্তিযোদ্ধায় রুপান্তরিত করল। তিনি এই ফ্লাইট নিয়ে ফ্লাই করতে অস্মীকার করলেন। মিলিটারি লিডার এর হাজারো হম্বি তম্বির পরও তিনি সীদ্ধান্ত থেকে এক চুল নড়লেন না। আর ক্যাপ্টেন না বললে কারো পক্ষে সম্ভব না এই প্লেন কে আকাশে ওঠানোর।
গ্রেফতার করা হলো নিজাম আহমেদ চৌধুরিকে। অন্য একজন পাকিস্তানি ক্যাপ্টেন কে দিয়ে উড়িয়ে নেয়া হলো সেই সৈন্য ভরতি বিমান। আর নিজাম আহমেদ চৌধুরিকে গুম করে ফেলা হলো। উনার স্ত্রী ছিলেন একজন জার্মান নাগরিক এবং সেই সময় উনি ছিলেন পূর্ব পাকিস্থানে। উনি অনেক কষ্টে জার্মান দুতাবাসের মাধ্যমে, জার্মান সরকার এর মাধ্যমে পাকিস্থানের উপর চাপ সৃষ্টি করে নিজাম আহমেদ চৌধুরিকে জীবিত ফেরত পান। কিন্তু তাকে পি আই এ থেকে বরখাস্ত করা হয় দ্বায়ীত্বে অবহেলা(!)র কারনে।
নিজাম আহমেদ চৌধুরির এই অসীম সাহসিকতা অন্য পাইলট দের অনেক অনুপ্রানিত করে। পাকিস্তানী রা এইটা বুঝতে পারতেসিল যে যেই আগুন নিজাম আহমেদ চৌধুরি জালাইসেন তা দাবানল এর মত জইলা ওঠা সময়ের ব্যাপার মাত্র। পি আই এর চারজন পাইলট তখনো ঢাকা ত্যাগ করতে পারেন নাই। পাকিস্তানি মিলিটারি এপ্রিল এর প্রথম সপ্তাহে এদের গ্রেফতার করে এবং ৩য় সপ্তাহে এদের সবাইকে হত্যা করে। এরা হলেন:
১) ক্যাপ্টেন সিকান্দার আলী (সেক্টর চীফ পাইলট, ইস্ট পাকিস্তান)
২) ক্যাপ্টেন আবু তাহের মোহাম্মদ আলমগীর (F-27 চালাতেন)
৩) ক্যাপ্টেন এন এস হায়দার (F-27 চালাতেন)
৪) ক্যাপ্টেন আমিনুল ইসলাম (F-27 চালাতেন)
এই সব অকুতোভয় সামরিক এবং বেসামরিক পাইলট দের অনেক অনেক শ্রদ্ধা মনের গভীর থেকে।