৪৪/৩৬৫

লেখার তারিখঃ এপ্রিল ১২, ২০১৫ । ১১.৪২ পি.এম

আবার জয়নুল চর্চায় ফেরা যাক। আগের লেখায় লিখসিলাম জয়নুল আবেদিন এর কলকাতা আর্ট কলেজে পড়ার সময়কাল এর কথা। পাশ করার আগেই উনি আর্ট কলেজে শিক্ষক হিসাবে জয়েন করার অফার পাইসিলেন। তাই পাশ করার পর পরি উনি কলকাতা আর্ট কলেজে শিক্ষকতা শুরু করেন।

শিক্ষক অবস্থায় উনার পার করতে হয় উনার শিল্পী জীবনের সবচেয়ে গুরুত্তপুর্ণ সময় এর। দুর্ভিক্ষের সময় টা। তার আগে মনে হয় বইলা নেওয়া ভাল দুর্ভিক্ষ টা ক্যান হইসিল। নাইলে মনে হবে উঠতি ফটোগ্রাফার দের মত উনি কিছু গরীব লোকের ব্ল্যাক এন্ড হোয়াইট ফটো তুইলা আইনা হিট হয়া গেসেন।

১৯৩৯ সাল। ২য় বিশ্ব যুদ্ধের শুরুর সাল। আস্তে আস্তে সব দেশ ই কোন না কোন ভাবে জড়ায় পরতাসিল যুদ্ধে। ভারত তখন ব্রিটিশ কলোনি। তাই মিত্র বাহিনী ই বলা যায় ভারত কে। জাপানিরা যখন বার্মা তেও বোমা ফালাইল তখন ইংরেজ সরকার ভাবলো কাম সারসে, শত্রু তো এক্কেরে উঠানে আয়া পরসে। ইংরেজ সরকার ভাবলো এর পর নিশ্চই জাপানিরা চিটাগাং এর দিক থেইকা অথবা পূর্ব মানে সিলেটের দিক থেইকা আক্রমন চালাবে বাংলায় তথা ভারতবর্ষে।

ইংরেজ বেকুব গুলা করলো কি বাংলা প্রদেশ অর্থাৎ পশ্চিম বাংলা আর বাংলাদেশর সব খাদ্য গুদাম থেইকা খাদ্য শস্য প্রায় সব ট্রান্সফার কইরা দিল ভারতের উত্তরপ্রদেশে। কিন্তু পাঠাইসে ঠিকইকিন্তু এগুলা মেইন্টেনেন্স এর কোন ব্যাবস্থা করে নাই। কিপটামি কইরা ফিরিজে থয় নাই আরকি। তাই যা হোয়ার হইল। সব খাদ্য শস্য গেল নষ্ট হয়া। জিনিষ পত্রের অপ্রাপ্যতার সুযোগে দাম বাইড়া গেল অনেক। যারা এক্টূ সচ্ছল ছিল তারা এক বেলা আধাবেলা খাইতে লাগলো যাতে বেশি খরচ না হয়।

ঝামেলায় পড়ল গরীব রা। দেশে কাজ নাই। ঘরে খাবার নাই। যাদের খাবার আছে তাদের নিজেদেরি হয় না, অন্যরে দিবে কি। একটু ভাত এর ফ্যান এর জন্য কারাকারি পইড়া যাইতে লাগলো। ডাস্টবিল এ কুকুর মানুষ আর কাক উচ্ছিষ্ট খাবার এর জন্য কারাকারি করা শুরু হইল। রাস্তায় পইড়া থাকতে লাগলো কংকাল সার মানুষের অভুক্ত দেহ। শুরু হইল বাংলা ১৩৫০ এর দুর্ভিক্ষ।

এক্টা ইস্যু ঘটলে আমরা যেমন ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়া আমি আর কি বা করতে পারি, অনেক কিছু কইরা লাইসি ভাবি, তেমন শিক্ষক জয়নুল আবেদিন এর এই সুযোগ তখন ছিল না। অবশ্য থাকলেও ফিলিং ছেড, ওয়াচিং পুর পিপল টাইপ ফাইজলামি করত কিনা সন্দেহ আসে।

উনি তাই করলেন যা একজন প্রকৃত শিল্পী মাত্রই করবেন। উনি ভাব্লেন আমি তো দুর্ভিক্ষ দূর করতে পারবো না। কিন্তু যারা পারবে তাদের মনে নাড়া দিতে পারবো এই সমস্যা সল্ভ করার জন্য। তিনি একজন আর্ট কলেজের শিক্ষক হওয়া সত্ত্বেও রাত, দিন, দুপুর ক্লান্তিহীন ঘুরে বেরাতে লাগলেন আর ক্ষুধার্ত মানুষের ছবি আঁকা শুরু করলেন। এভাবে তিনি প্রায় কয়েকশ স্কেচ করেন। আমাদের একটা ভুল ধারনা যে আমরা জয়নুল আবেদিন এর আঁকা দুর্ভিক্ষের যেই ছবি গুলা দেখি সেগুলাই এই স্কেচ । কিন্তু তা আসলে না। সারাদিন স্কেচ করার পর উনি ১৪ নম্বর, সারকাস রোড এর বাসায় ফিরা গিয়া স্কেচ গুলোকে ড্রয়িং এ কনভার্ট করতে বসতেন।

জয়নুল ছবি গুলা আকসিলেন বাদামী রঙ এর মোটা মোড়কের কাগজে। কালো কালি দিয়ে একটু মোটা রেখায় ড্রয়িং করা। তুলি হিসাবে ব্যাবহার করেছেন তেল রঙ এর চ্যাপ্টা তুলি।

জয়নুল আবেদিন এর এই ছবি গুলা নিয়া প্রথম ১৯৪৪ সালে ভারতীয় কম্যুনিস্ট পার্টির উদ্যোগে কলকাতা কলেজ স্ট্রিট মার্কেটে প্রদর্শনী হয়। প্রদর্শনীর নাম ছিল “দুর্ভিক্ষ ১৩৫০”

মুটা মুটা শিল্প রসিক, শিল্প বোদ্ধা এমন কি আমার মত হাভাইত্যা দর্শক ও এই ছবিগুলা দেইখা প্রচন্ড বিষ্মিত ও বিমোহিত হন। সিমপ্লিসিটির জন্য এত সাধারন রেখা দিয়াও যে এত ইমোশনাল কাজ করা যায় তা জয়নুল সবাইকে দেখায় দিলেন। এই প্রদর্শনী এত বিখ্যাত হয় যে কলকাতা ছড়ায়ে এই একই প্রদর্শনী আবার দিল্লি তেও করতে হয়। সেইখান থেইকা ছড়ায়া পরে সারা বিশ্ব। এই দেশের মানুষ দের প্রতি ইংরেজ শাসক দের চরম অবহেলার প্রতিক হয়া থাক্লো এক একটা ছবি।

এই প্রদরশনীর সাফল্যে জয়নুল আবেদিন ছাত্র শিক্ষক সবার কাছে প্রিয় পাত্র হয়া উঠেন। কলকাতা কেন্দ্রিক বুদ্ধিজিবি সমাজেও জয়নুল আবেদিন এর হেভি পপুলারিটি দেখা যায় এই সময়।

২য় বিশ্ব যুদ্ধ শেষ হয় ১৯৪৫ সালে। ১৯৪৬ সালে জয়নুল আবেদিন বিয়ে করেন মিরপুরের জনাব তৈয়ব ইদ্দিন এর কন্যা জাহানারা বেগম কে। তারপর কলকাতার ১৪ সার্কাস রোড এর একলা থাকার এক কাম্রার বাসা টা ছাইরা দিয়া নতুন বাসা ভাড়া নিলেন ঢাকার লেক সার্কাস এ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *