লেখার তারিখঃ এপ্রিল ২২, ২০১৯, ৮:২৩ পি এম
কলম্বিয়ার শেষ মিশন । পর্ব ২
কলম্বিয়া ডিজ্যাস্টার এর টেকনিকাল কারন গুলোর পাশাপাশি যে বড় ধরনের কিছু প্রাতিষ্ঠানিক এবং ব্যাবস্থাপনামূলক কারন ও ছিল তার গভিরে ঢোকার আগে আমাদের NASA এবং নাসার পরিচালিত বিভিন্ন প্রজেক্ট ও কার্যক্রম এর ব্যাপারে কিছু ধারনা থাকা প্রয়োজন। তাই আমি আজকের লেখায় গল্পটা আরো পেছন থেকে বলা শুরু করছি যাতে আমরা ধাপে ধাপে পুরো ব্যপার টার ব্যাপ্তি অনুধাবন করতে পারি।
১৯৫৭ সালে সোভিয়েত রাশিয়া মহাকাশে স্পেস ইতিহাসের প্রথম স্যাটেলাইট স্পুটনিক প্রেরণ করে। এর জবাবে তার পরের বছরই অর্থাৎ ১৯৫৮ সালে আমেরিকার কংগ্রেস এবং প্রেসিডেন্ট আইসেনহাওয়ার গঠন করেন National Aeronautics and Space Administration বা যাকে আমরা NASA নাম এ চিনি। এ ব্যাপারে আমেরিকা যে প্রচন্ড রকম সিরিয়াস ছিল তার ধারনা পাওয়া যায় ১৯৬০ সালে প্রেসিডেন্ট এর বিজ্ঞান বিষয়ক পরামর্শক কমিটির রিপোর্ট এ। সেখানে বলা হয় “আমরা মহাকাশ জয়ের এক দৌড়ে নেমে পড়েছি। এই দৌড়ে কেউ কেউ ভাবছেন নতুন এবং রোমাঞ্চকর বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার এর কথা যা নিশ্চিত ভাবেই হতে যাচ্ছে। কেউ কেউ ভাবছেন পরিচিত যুদ্ধক্ষেত্রের সীমানা ছাড়িয়ে মানুষকে এমন জায়গায় নিয়ে যেতে যা এতদিন ছিল কল্পনাতীত”
প্রতিষ্ঠার প্রথম দুই যুগে নাসা বেশ কিছু বড় বড় প্রজেক্ট হাতে নিয়েছিল। এই প্রোগ্রাম গুলোর মধ্যে ছিল বিভিন্ন এরোনেটিক রিসার্চ প্রজেক্ট, চাঁদে বৈজ্ঞানিক গবেষনার জন্য প্রোব পাঠানো এবং দেশের সর্বপ্রথম মানুষবাহী মহাকাশযান প্রেরণ। এ সব কিছুই আমেরিকার মানুষ দারুণ আগ্রহ নিয়ে দেখছিল।
প্রতিষ্ঠার তিন বছর এর মাথায় ১৯৬১ সালের ৫ই মে, প্রথম আমেরিকান নাগরিক হিসাবে মহাকাশ ভ্রমণ করেন এলান শেপার্ড । এটি ছিল মারকারি ক্যাপসুল এ করে ১৫ মিনিট এর একটি সাবঅর্বিটাল মিশন। পরের পাঁচ বছরে আরো কিছু মারকারি এবং জেমিনি ক্যাপসুল মানুষের স্পেস ফ্লাইট এর সক্ষমতা পরীক্ষা করতে ব্যবহার হয়। একই সাথে পরীক্ষা চালানো হয় মহাকাশে মিলিত হওয়া কিংবা ডকিং এর মত স্পেস অপারেশন এর ও।
১৯৬১ সালে প্রেসিডেন্ট কেনেডি ঘোষনা দ্যান এই যুগ শেষ হওয়ার আগেই আমেরিকা চাঁদে এস্ট্রোনাট পাঠাবে। এই স্বপ্ন সত্য হয় এপোলো প্রোগ্রাম এর ১১ তম মিশন এ যখন ১৯৬৯ সাল এর ২০ শে জুলাই নীল আর্মস্ট্রং এবং বাজ অলড্রিন চাঁদের বুকে প্রথম মানুষ হিসাবে ইতিহাসের পাতায় জায়গা করে নেন। উচ্চারিত হয় আর্মস্ট্রং এর সেই বিখ্যাত উক্তি “মানুষের জন্য ছোট এক পদক্ষেপ, মানবজাতির জন্য বিরাট এক লাফ”
এপোলো প্রজেক্ট এর খরচ ছিল মারাত্বক বেশি। মারাত্মক শব্দ ব্যবহার করার কারণ হল ২৫.৬ বিলিয়ন ডলার শুধু টাকার অংকে বেশি সে জন্য নয়। ১৯৬৭ সালে লঞ্চ প্যাড এ একটি এপোলো ক্যাপ্সুল এ আগুন ধরে যায় এবং তিন জন এস্ট্রোনাট এর সবাই ঘটনাস্থলেই মৃত্যু বরণ করেন। এই ঘটনার পরে কংগ্রেস নিয়ম করে দ্যায় যে Aerospace Safety Advisory Panel নামে একটি উচ্চ পর্যায়ের প্রতিষ্ঠান মহাকাশ এ মানুষ প্রেরণের সকল কার্যক্রম তদারকি করবে। নাসাও এই আদেশ মেনে তাদের সকল হিউম্যান স্পেস ফ্লাইট সেন্টারে অতিরিক্ত সেফটি অফিস স্থাপন করে।
২য় আরেকটি দূর্ঘটনা হতে নাসা প্রায় বেঁচে যায় এপোলো থারটিন মিশনে ১৯৭০ সালে যখন চাঁদের দিকে ধাবিত হওয়ার সময় তাদের প্রাইমারি অক্সিজেন ট্যাংক বার্স্ট করে। প্রথমে মিশন কন্ট্রোল এর লোকেরা ভেবেছিলেন হয়তো এপোলো থারটিন এর ইন্সট্রুমেন্ট কোন ভুল রিডিং দিচ্ছে। কিন্তু কিছুক্ষন পরেই বেতারে ভেসে আসে এস্ট্রোনোট জেমস লোভেল এর বার্তা “ হিউস্টন, উই হ্যাভ এ প্রব্লেম”। ফ্লাইট ডিরেক্টর জিন ক্রাঞ্জ দ্রুত তৎপর হন অবস্থার গভিরতা পরিমাপ করতে। তিনি পাগলের মত একটা সমাধান খুজতে থাকেন যেখানে মিশনের এস্ট্রোনাটদের আপাতত টিকে থাকার উপায় বের করা যায় এবং সাথে সাথে একটা টীম গঠন করতে থাকেন যারা বের করবে কিভাবে এস্ট্রোনাটদের কে নিরাপদে পৃথিবী তে ফিরিয়ে আনা যায়।
প্রথমেই ক্রাঞ্জ বের করেন এস্ট্রোনাটরা লুনার এক্সকারশন মডিউল এর ভেতর আপাতত আশ্রয় নিতে পারেন। এরপর তিনি একটি “টাইগার টীম” গঠন করেন যার সদস্য ছিল বিভিন্ন বিষয়ের এক্সপার্টরা। টাইগার টীম হলো একটি বিশেষায়িত টীম। যখন অরবিট এ থাকা কোন মিশন হঠাত বড় ধরনের কোন সমস্যার সম্মুখীন হয় তখন নাসা এবং ইউনাইটেড স্পেস এলায়েন্স এর ইঞ্জিনিয়ার দের প্রধান করে মিশন ইভালুএশন রুম (MER) ম্যানেজার এরকম টাইগার টীম গঠন করার ক্ষমতা রাখেন।
টাইগার টীম সেযাত্রা বিভিন্ন অভূতপূর্ব কিন্তু সরল সমাধান দিয়ে এপোলো থারটিন কে রক্ষা করে । এপোলো থারটিন এর এই দূর্ভাগ্যজনক যাত্রার কিছুদিন পরেই ১৯৭৫ সালে নাসা আগামী ছয় বছর এর জন্য মানুষবাহি মহাকাশ যাত্রা স্থগিত করে।
কিন্তু তাতে কি দূর্ঘটনা বন্ধ হয়েছিল? কলম্বিয়া ডিজেস্টার এর সময় কি টাইগার টীম এর মত কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয় নি? এসব প্রশ্নের উত্তর গুলো আমি ধীরে ধীরে সামনের পর্ব গুলোয় সামনে নিয়ে আসবো।