২০৬/৩৬৫

লেখার তারিখঃ সেপ্টেম্বর ২২, ২০১৫ | ১২.৫২ এ এম

 

আমি এখন পর্যন্ত দুইবার বাসা থেইকা পালাইসি। একবার অনেক ছোট থাকতে স্কুল এও ভর্তি হই নাই। আরেকবার ক্লাস এইট এ থাকতে। ছোট বেলার টা খুব বেশি মনে নাই। শুধু মনে আছে জয় নামে আমার একটা খেলার সাথি ছিল তার সাথে কই জানি গেসিলাম গা। অনেক খন পর বাসার সবাই মিলা খুঁজতে বাইর হয় আর এক বাসার সিড়ি তে বইসা বইসা চকলেট খাইতাসি অবস্থায় উদ্ধার করে।

 

২য় বার এর পালানি টা সিরিয়াস ছিল। কয়দিন ধইরা বাসায় অনেক কথা বার্তা শুনতে সিলাম। আমি ক্যান পড়ালেখা করি না, সারাদিন খালি ক্রিকেট খেলি ক্যান, আমারে পাইলা যে ওদের কোনই লাভ হইতাসে না ইত্যাদি ইত্যাদি।  এই সব শুনতাম আর বাসায় আইসা দুইটা বন্ধুর সাথে শেয়ার করতাম। আমার বেস্ট ফ্রেন্ড ছিল পুরাই আউট ল দুইটা ছেলে। আমার ক্যান জানি ভদ্র, চুল আচ্রানি, পড়ালেখায় ভাল টাইপ ছেলেদের সাথে যাইত না। আমার বেস্ট ফ্রেন্ড ছিল হয় স্পোর্টস এ ফার্স্ট, পড়ালেখায় লাস্ট এমন টাইপ পোলাপান, নাইলে বাসাবো এলাকার বিরাট ত্রাস এমন।

 

এরা আমারে বুদ্ধি দিসিল, দ্যাখ দোস্ত, বাসার লোকজন তোকে কত অত্যাচার করে। তুই স্বাধীনতা সংগ্রাম কর। ওদের বুঝায় দে যে তুই দা ম্যান। তুই পালায়া যা। নতুন জীবন শুরু কর। আমার মামার বাড়ি আছে রাজশাহী তে। ওই খানে তোরে নিয়া যাবো।কেউ খুইজা পাবে না। ওইখানে দেখবি কত আদর যত্ন করে তোরে। আমি শুনতাম আর স্বপ্ন দেখতাম। আহা রাজশাহী, না জানি কত স্বপ্নপুরী ওইটা। গেলেই খালি খাতির আর যত্ন।

 

তারপর থেইকা খালি পালায় যাওয়ার বাহানা খুঁজতাম। আর সেই বন্ধু দুইটার সাথে প্ল্যান করতাম, স্বপ্নের রাজশাহী গেলে কত কি করবো। একদিন বাসায় আব্বা আম্মা নাই। কারেন্ট ও নাই। বাসায় খালি আমি আর ছোট খালা যাকে আমি মা ডাকি ছোটবেলা থেইকাই। কারেন্ট গেলে আগে পারায় পারায় এমন বিকট আওয়াজ কইরা জেনারেটর চালু হয়া যাইত না। মোমবাতি জ্বালায়া চুপচাপ অপেক্ষা করা লাগতো।

 

আমি হাতের কাছে যাই পাইতাম সেইটা মোমবাতি তে পুরতে কেমন লাগে দেখতাম। কলম, পেন্সিল, স্কেল, বোতল শব মোমবাতিতে ধইরা বইসা থাকতাম। এরমই অনেক কিছু পুড়াইতাসিলাম বইসা বইসা এমন সময় মা আসলো। আইসা আমার কাজ কারবার দেইখা চিল্লান দিল একটা, কি করওওওস আগুন লাগবো তো। বইলাই দিল এক থাপ্পড়।

 

আমার এত অভিমান হইল। আমি থাপ্পড় এর ব্যাপারে প্রচণ্ড সেন্সেটিভ। চোখে পানি আইসা পরে ফাইজলামি কইরা মারলেও। আমার মনে হইল আমার দুনিয়ায় কেউ নাই। আমি আর থাকুম না এই বাসায়। একটু পরে মা যখন টিভি দেখতে দেখতে ঘুমায় গেল, আর আব্বা আম্মা তখনো ফেরে নাই, আমি আস্তে আস্তে আমার ক্রিকেট এর ব্যাগ টাতে ট্রাউজার, শার্ট ভরলাম। তারপর দরজা খুইলা বাইর হয়া আইসা পরলাম বাসা থেইকা।

 

বার বার মনে হইতাসিল এখনই ওই পালাইলো, পালাইলো আওয়াজ উঠলো। কোনমতে একটা রিকশা নিয়া আসলাম ওই বন্ধুর বাসার কাছের এক ফোন এর দোকানে। মনে রাখতে হবে  সময় টা ১৯৯৬ সাল। মোবাইল ফোন চোখেই দেখি নাই জীবনে। বন্ধুর টি এন্ড টি ফোন এ ফোন দিলাম, দোস্ত আমি তো পালায়া আইসা পড়সি, এখন কি করুম। অনেক খন সাইলেন্স ওই পাশে। তারপর বলল, তুই বাসার নিচে অ্যায় আমি নামতাসি। বাসার নিচে দাঁড়াইলাম, একটু পরে বন্ধু দুইজন আসলো। এরা খুবি বিরক্ত আমি ক্যান প্ল্যান হওয়ার আগেই আইসা পরসি।

 

কথা বার্তার পর প্ল্যান হইল যে দুই জন এর বাসাই তো আমার আম্মা আব্বা চিনে, এদের বাসায় রাতে থাকা যাইবো না।  বন্ধুর এক পাড়াতো বন্ধুর বাসায় নিয়া গেল থাকতে। বলল, আনটি এদের বাসায় অনেক গেস্ট আসছে তো, আজকে রাতটা একটু থাকতে দেন। উনারা ভাল মানুষ ছিল, আমাকে থাকতে দিল, রাতে শিং মাছ আর ডাল দিয়া ভাত ও খাইতে দিসিল। আমি মাছ বাইছা খাইতে পারি না, বার বার চোখে পানি চইলা আস্তেসিল বাসার কথা ভাইবা।

 

বন্ধু বইলা গেল আজকে রাতে এইখানে থাইকা কালকে সকাল ৯ টায় ধান্মন্ডিতে ঢাকার তখনকার দুই মাত্র আইসক্রিম পার্লার রেইনবো আইসক্রিম এর সামনে দাঁড়াইতে। ওরা আইসা তারপর আমাকে রাজশাহী নিয়া যাবে। আমি খুব ভোরে ওই বাসা থেইকা উইঠা আইসা চুপি চুপি চইলা আসলাম রাস্তায়। তারপর একটা বেবি ট্যাক্সি নিয়া ধান্মন্ডি। তখন বাজে ৭ টা। ওরা আসবে ৯ টায়। এই দুই ঘণ্টা করবো কি। ধান্মন্ডি এর কিচ্ছু চিনতাম না তখন। লেক এর পারে বইসা থাকলাম কিছুক্ষণ। তারপর হাট তে হাট তে একটা নির্জন গলি তে ঢুইকা গেলাম। ওই খানে ব্যাগ থেইকা ক্রিকেট এর ট্রাউজার আর জার্সি বাইর কইরা পইড়া নিলাম, যাতে মনে হয় সকালে খেলতে গেসিলাম ফিরতাসি। তারপর আবার ধান্মন্ডির রাস্তায় হাটাহাটি। ওই দিকে আমাদের বাসায় তখন তোলপাড় চলতেসিল।

 

সারা রাত কেউ ঘুমায় নাই। ঢাকা শহরের সব আত্মীয় স্বজন চইলা আসছিল বাসায়। আম্মা কান্তে কান্তে অজ্ঞ্যান হওয়া যাইতেসিল একটু পর পর। যেই খালা চড় মারসিল উনি কান্তেসিল ননস্টপ। বাবা কাজিন রা স্টেশন, থানা, হাসপাতাল সব চইশা ফালাইতেসিল। আমার ক্লাস এর বন্ধুরা সব জাইনা গেসিল যে আমি পালাইসি বাসা থেইকা। আইডিয়াল স্কুল এ আমাদের খুবি মানসিক প্রতিবন্ধী বানায় রাখা হইত। লাইব্রেরিতে তালা থাকতো। জাতীয় সংগীত গাওয়া যাইত না। এসেম্বলি তে মিউজিক বাজানো হইত। স্যার গুলা সাইকো দের মত ফিসিকাল টর্চার করতো। এসব এর মধ্যে কেউ এরকম কিছু করার কথা ভাবতেও পারে সেইটা ওদের কাছে অবিশ্বাস্য একটা ব্যাপার ছিল।

 

ওরা বুঝতে পারসিল যে আমি কাদের সাথে প্ল্যান কইরা পালাইসি। একটা ফ্রেন্ড ছিল আমার নাম রাকিব। বেস্ট ফ্রেন্ড দের একজন। সে জানতে পারলো যে আমরা রাজশাহী যাওয়ার প্ল্যান করসি আর আমি ওয়েইট করতেসি ধানমন্ডি রেইনবো এর সামনে। সে আমাদের বাসায় ফোন কইরা এই তথ্য টা জানায় দিল।

 

আমি বইসা ছিলাম রেইনবো এর সামনের ফুটপাথ এ। সব কিছু কেমন স্লো মোশন এ হয়া গেল তারপর। আমি দেখলাম একটা বেবি টেক্সি আইসা থামলো। প্রথমে বাবা বের হইল তারপর আম্মা, তারপর বড় চাচি। ওরা সব আমার দিকে দৌড়াইয়া আস্তেসিল স্লো মোশন এ। আমি ওদের দিক থেইকা ঘুইরা গেলাম। ভাবলাম, আচ্ছা আমি কি দৌড় দিব?  ওরা যদি বেবি টেক্সি নিয়া আমারে ফলো করে?

 

এই সব ভাবতে ভাবতে এক পা দুইপা আগাইতেসি আর পিছন থেইকা অনেক গুলা হাত আইসা আমারে খপ কইরা ধরল। “কই ছিলি তুইইইইই, কই চইলা গেসিলি??? “ তারপর বিশাল কান্না কাটি আর বিলাপ। আশে পাশে শত শত লোকজন জইমা গেল তামশা দেখতে। আমি শুধু মাটির দিকে তাকায় বললাম “আস্তে, আস্তে”

 

এই পর্যন্তই কাহিনী থাক। ইদানীং পালায় যাওয়ার ইচ্ছাটা আবার ভর করসে মাথায়। এখন পালায় যাওয়া এত কঠিন হয়া গেসে।  যাইতেই পারতাসি না।

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *