১৬২/৩৬৫

লেখার তারিখঃ আগস্ট ০৮, ২০১৫ । ১১.৪৩ পি এম

নটর ড্যাম এ ফার্স্ট ইয়ার এ পড়ার সময় আমার একটা স্যার ছিল। প্রাইভেট টিউটর। বুয়েট থেইকা পাস করা। ভাল লাম মনে নাই। ডাক নাম ইকো। আমার বাবার বন্ধুর ছেলে হয়। তাই ইচ্ছা না থাকলেও আমাকে আর অভিকে উনার কাছে পড়তে পাঠানো হইল। কারণ তখন আমাদের বাসার বুয়েট নাম টা ব্যাপক উৎসাহ উদ্দীপনা ও ধর্মীয় ভাব গাম্ভির্জ এর সাথে উচ্চারণ করা হইত। আমার মা বাবার ধারনা ছিল যেহেতু সে বুয়েটে পড়ে সেহেতু সে ফিজিক্স, ক্যামিস্ট্রি, বাংলা, ইংরেজি, পিটি ক্লাস ইত্যাদি সব ই পারে। এই টিউটর কে তো হাতছাড়া করাই যাবে না। সে যে দয়া কইরা আমাদের পড়াইতে রাজি হইসে এই তো অনেক।

দুই দিন পইড়া অভি শালা কাট মারলো। কারণ ওই লোক অনেক বকা ঝকা করতো। উনারা যে ম্যাথ, ফিজিক্স, কেমিস্ট্রির বই পইড়া আসছেন (সব এসো নিজে করি বেজড) তার সাথে আমাদের বই এর কোন মিল এ ছিল না। তাই উনি পড়াইতে গিয়া প্রায় ই প্যাচ লাগায় ফেলতো। আর সেই পুরা রাগ ঝাড়তও আমাদের উপর। অভি এদিকে বায়োলজি পড়তে হবে বাহানায় ইনার কাছে আসা বন্ধ কইরা দিল।

অভি চইলা আসার পর আমার উপর উনার মানসিক অত্যাচার আরো বাইরা গেল। উঠতে বসতে বকা দিত। খাতা ছুঁইরা ফালায় দিত। আমি বাসায় কিছু বলতেও পারতাম না। কারণ বললে বলতো, যেই পড়া দ্যায় পারস নাই, তাই বকা দিসে, ঠিক ই আসে , বেশ করসে। সেলফ ইস্টিম কমতে কমতে মাইনাসের ঘরে চইলা গেসিল।

এর মধ্যে একদিন উনি ফিজিক্স পরীক্ষা নিবে। আমি পরীক্ষা দিতে বইসা দেখি অঙ্ক গুলা পারবো, কিন্তু বাকি প্রশ্ন যে কই থেইকা করসে উনি যানে আর আল্লাহ। তো সব মিলায় আমি অনেক ক্ষণ বইসা ছিলাম কেমনে কি করব চিন্তা কইরা। এমন সময় উনি বাসার ভিতর থেইকা আসলেন। আসা দেখলেন আমি সাদা খাতা নিয়া চিন্তা করতাসি।

ব্যাস উনার গেল রাগ উইঠা। বলল, রাখ, পরীক্ষা দেওয়া লাগবে না। বইলা খাতা টা নিয়া বারান্দা দিয়া নিচে ফালায় দিলেন। ওই টা আমার কলেজের খাতা ছিল। তারপর বললেন ব্যাগ গুছায় আমার সাথে আসো। বইলা আমারে নিয়া বাসার দরজার সামনে দার করাইলেন। তারপর বললেন,

“তুমি ইন্টার তো দুরের কথা, ফার্স্ট ইয়ার ই পাস করতে পারবা না। আর যদি ফার্স্ট ইয়ার পাস ও কর এর ওর টা দেইখা লিখা তাইলেও ধরা খাবা ইন্টার এ গিয়া। একবারে পাস করতে জীবনেও পারবা, এইটা তোমার মত স্টুডেন্ট দের কর্ম না। তারপর ডিগ্রি কলেজে গিয়া অনার্স পইরো রাষ্ট্র বিজ্ঞান এ। বুয়েট এ পড়া লাগবে না। তোমার আব্বা কে গিয়া বইলা তোমাকে একটা মুদির দোকান নাইলে সেলুন খুইলা বসায় দিতে। এ ছাড়া আর কিছু করার যোগ্যতা তোমার নাই”

এই টুকু বইলা উনি মুখের উপর দরজা বন্ধ কইরা দিল। ওই বয়সে এত অপমান আমারে কেউ করে নাই। আমার মনে হইতাসিল আমি রাস্তায় গিয়া একটা ট্রাক এর সামনে দাড়ায় যাই। কি হবে আর বাইচা থাইকা। রিকশায় আস্তে আস্তে আমার মনে হইতাসিল সারা শহর এর লোক আমার দিকে তাকায় আসে। আমি খালি কান্তে সিলাম আর কান্তে সিলাম আর শার্ট এর হাতায় চোখ মুছতাসিলাম। টিস্যু ছিল না। বাসায় যাতে কানসি বুঝতে না পারে ওই জন্য মসজিদে ঢুইকা অজু খানা থেইকা চোখে মুখে পানি দিয়া তারপর বাসায় ঢুক্সিলাম। তখন রাত ৯ টা বাজে।

বাসায় ঢুকার একটু পরেই আম্মা ভাত খাইতে বসাইল। তখন জি বাংলা ছিল না। তাই ভাত খাওয়ার সময় আম্মা টেবিলে পাসে বইসা থাকতো। আমি খাইতাসি আর আমার দুনিয়া ভাইঙ্গা কান্দা আস্তাসে। আমি কোন মতে সাম্লাইতাসি তারপরও টপ টপ কইরা পানি পরতাসে চোখ দিয়া। আম্মা দেখলো আর সাথে সাথে চিৎকার দিয়া উঠল, এই কি হইসে তোর, এদিকে তাকা, কি হইসে তোর, কলেজে কিসু হইসে, বলস না ক্যান? আমি জীবনেও কিছু বলতাম না,যদি না পাশে থেইকা অইভ্যা বলত, মেঝু, (আমার আম্মা অভির মেঝ খালা)ইথার ভাইয়ার দোষ নাই। ইকো ভাই পড়াইতে পারে না আর সব রাগ ঝাড়ে আমাদের উপর। আজকে অনেক খারাপ খারাপ বকসে ইথার ভাইয়া রে। আম্মা আমার দিকে তাকায় ছিল অনেক ক্ষণ, আমি চোখ তুইলা তাকাইতে পারি নাই, আমার সামনে তখন একটা ঝাপ্সা ভাত এর প্লেট আর মুখে নোনতা নোনতা ভাত এর লোকমা। আম্মা শুধু বলল,

“কালকে থেইকা তুই আর যাবি না ওই স্যার এর কাছে, বুয়েটের থেইকা যদি এমন অমানুষ পয়দা হয়, আমারার দরকার নাই বুয়েট”

তারপর আমি আর কোন পরীক্ষায় ফেইল করি নাই। ইন্টার পাশ করসি, ন্যাশনাল প্রোগ্রামিং প্রতিযোগিতায় আহসানুল্লাহ ইউনিভার্সিটিকে রিপ্রেজেন্ট করসি, কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারিং এ গ্রাজুয়েশন করসি, ই-প্রথম আলো বানাইসি, গ্রামীণ এ রিটেন ভাইবা পাস কইরা চাকরি পাইসি। এই গুলা শো অফ এর জন্য বলতাসি না, এই গুলা সে সব মাইল স্টোন যে গুলার প্রত্যেকটার পরে আমি ওই “ইকো” নামের লোকটারে মনে করসি যে আমারে তার বাসা থেইকা বাইর কইরা দিসিল ফিজিক্স এর দুইটা সূত্র ভুইলা গেসিলাম বইলা, আর বলসিল আমি ইন্টার ফার্স্ট ইয়ার ই পাস করতে পারবো না।

আমার অনেক ইচ্ছা করতো, প্রত্যেক বার তারে গিয়া বইলা আসি দেখেন আমি এই করসি, দেখেন আমি ওই করসি। কিন্তু কিছু বলি নাই। প্রতিশোধ নিলে তো হওয়াই গেল। আমি তো ওই লোক টার লেভেলে “নামতে” পারি না। আমি জীবনে কি করসি সেইটার জন্য তো আমার তার এপ্রুভাল দরকার নাই। আমি তার বিচার করার ভার টা সব চেয়ে বড় বিচারক এর হাতেই ছাইরা দিসি। উনি ই ভাল বুঝবেন কি করা লাগবে।

 

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *