৮৭/৩৬৫

লেখার তারিখঃ মে ২৫, ২০১৫ । ১১.০৭ পি.এম

আগের কয়েকটা লেখায় আমি মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশ বিমান বাহিনী কেমনে গঠিত হইল বলসি, কেমনে বিমান বাহিনীর জন্য বিমান সংগ্রহ হইল বলসি আর বলসি বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর প্রথম ইউনিট যা মুক্তিযুদ্ধে অংশ ন্যায় সেই কিলো ফ্লাইট এর কথা। আজকে কিলো ফ্লাইট এর প্রথম মিশন অর্থাৎ বাংলাদেশ এর সীমার ভিতরে, পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর স্থাপনার উপর, আমাদের প্রথম বিমান আক্রমণ এর কাহিনী বলার চেষ্টা করব।

সকল তথ্যের উৎস আগের লেখা গুলায় বলসি অনেক বার। তাই শুধু শুধু আর ক্লাটারড করলাম না লেখা টা। তথ্য সূত্র আগের বই আর ইন্টারনেট এর লিঙ্ক গুলাই। ভাল হয় যদি ব্যাকগ্রাউন্ড এ চল চল চল গান টা ছাইড়া নেন। না ছাড়লেও ক্ষতি নাই। পইড়া আমার লিখার সময়ের মত গুজবাম্প হইসে কিনা জানায়েন 🙂

আগের লেখায় বলসি যে কিলো ফ্লাইট এ বিমান ছিল তিনটা । তার মধ্যে যে Alouette-III হেলিকপ্টার টা ছিল সেইটাকে ২ রা ডিসেম্বর, ১৯৭১ বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর অস্থায়ী ঘাটি ডিমাপুর থেইকা কইলাশহর নিয়া আসা হয়। এই দিনেই হেলিকপ্টার এর পাইলট দুইজন হেলিকপ্টার টাকে আগরতলা থেইকা ৭০ কি,মি পূর্বে তেলিয়ামুড়া তে নিয়া যান। হাই কমান্ড এর ডিসিশন ছিল পরের দিন অর্থাৎ ৩ রা ডিসেম্বর রাত এ দুইজন বৈমানিক হেলিকপ্টার টা নিয়া উড়বেন এবং প্রাইমারি টার্গেট এ আক্রমণ চালাবেন। প্রাইমারি টার্গেট নির্ধারণ করা হয় নারায়ানগঞ্জের গোদনাইল তেলের ডিপো। বিমান টি পরিচালনার দায়িত্তে ছিলেন স্কোয়াড্রন লিডার সুলতান মাহমুদ এবং ফ্লাইং অফিসার বদরুল আলম জিডি (পি)। সাথে থাকবেন মেশিন গান চালানোর জন্য একজন গানার। গানার এর কাছে এক বস্তা মুক্তিযোদ্ধা আর দেশের মানুষদের উজ্জীবিত করতে লিফলেট দেওয়া হইল। বলা হইল লিফলেট ফেলার সময় জাতে বস্তার গিট্টু খুইলা তারপর ফালায়। গানার মিয়া এই বস্তা কি করসিল সেই বেপারে এই কাহিনীর শেষে জানতে পারবেন। আমি অনেক ট্রাই করলাম গানার এর নাম জানতে কিন্তু কোথাও কোন রেকর্ড নাই। তাই আপাতত আমরা তাকে গানার ই বলবো।

আমাদের পাইলট রা প্রস্তুত হইতে থাক মুক্তিযুদ্ধের প্রথম এরিয়াল মিশনের জন্য এই ফাকে দুই জন সম্পর্কে একটু সংক্ষেপে বইলা রাখি।

স্কোয়াড্রন লিডার সুলতান মাহমুদ একজন অসাধারণ মুক্তিযোদ্ধা। কিলো ফ্লাইট এর অধীনায়ক ছিলেন তিনি। কিলো ফ্লাইট এ যোগ দেয়ার আগে তিনি পশ্চিম পাকিস্তান থেইকা প্রায় শূন্য হাতে পালায় চইলা আসেন আর সরাসরি মুক্তিযুদ্ধের সম্মুখ সমরে যোগ দেন। চট্টগ্রাম এর মদনাঘাট এর বিদ্যুৎ কেন্দ্র ধ্বংস কইরা দিয়া পূরা চট্টগ্রাম ব্ল্যাক আউট কইরা দেন এই সুলতান মাহমুদ। এই অপারেশন এ তার পায়ে গুলি লাগে। কিন্তু তারপর ও তিনি বিমান বাহিনী গঠিত হওয়ার খবর পাইয়া চইলা আসেন আর কিলো ফ্লাইট এর অধিনায়ক এর দায়িত্ব গ্রহণ করেন।

ফ্লাইং অফিসার বদরুল আলম জিডি (পি) পাকিস্তান বিমান বাহিনীর অন্যতম টেলেন্টেড ফাইটার পাইলট ছিলেন। তিনি প্রথম বাঙালি যিনি পাকিস্তান বিমান বাহিনীর সুপার সনিক স্কোয়াড্রন এ সিলেক্টেড হন। এয়ার টু সার্ফেস রকেট আক্রমণে তার রেকর্ড কয়েকবছর পুরা পাকিস্তান বিমান বাহিনীর কেউ ভাঙতে পারে নাই। তিনি ছিলেন F-6 বিমান এর স্কোয়াড্রন এ। মজার জিনিশ হইল এই স্কোয়াড্রন নিয়া পড়তে গিয়া আমি পাইসি ২৫নং স্কোয়াড্রন এর মটো ছিল “চির উন্নত মম শীর” । তিনি চাইলেই ফাইটার স্কোয়াড্রন এর অনেক উপরের পোস্ট এ যেতে পারতেন। কিন্তু ১৯৭০ সালের উপকূলীয় জলচ্ছাস এর পর পাকিস্তান বিমান বাহিনী দুইটা H-19 হেলিকপ্টার পাঠায় উদ্ধার কাজে। তিনি দেশের সেবা করার জন্য এই হেলিকপ্টার এর বৈমানিক হিসাবে চইলা আসেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হইলে তাকে পশ্চিম পাকিস্তান এ বদলী করা হয়। কিন্তু তিনি অনেক কষটে পালায়া আইসা যোগ দেন কিলো ফ্লাইট এ, Alouette-III হেলিকপ্টার এর পাইলট হিসাবে।

মুল কাহিনী তে ফেরত আসি। ৩রা ডিসেম্বর, ১৯৭১। রাত বারোটার একটু আগে হেলিকপ্টার স্টার্ট দেওয়া হইল। ইতিমধ্যে এই সাধারণ লাইট ট্রান্সপোর্ট হেলিকপ্টার কে কাস্টমাইজ কইরা যুদ্ধের উপযোগী করা হইসে। এর সাথে লাগানো হইসে দুই পাশে ৭+৭ ১৪ টা রকেট সহ রকেট পড, মেশিন গান আর পাইলট দের নিচে পুরু ইস্পাতের পাত যাতে গোলাগুলির সময় গুলি আইসা না লাগে। আবার নেয়া হইসিল লিফলেট এর বস্তা।

এত কিছু লাগানোর ফলে হেলিকপ্টার এর সেন্টার অফ গ্রাভিটি গেল চেঞ্জ হয়া। টেক অফ করতে পারতেসিল না দুই পাইলট এর অনেক চেষ্টার পর ও । তাইলে কি এত দিনের সব প্রশিক্ষণ, এত ত্যাগ সব ব্যারথ হয়া যাবে? প্রথম মিশন এবরট করা লাগবে শেষ মেষ টেক অফ না করতে পারার কারণে?

এত সোজা? আমরা তো বাঘ। বাঘ রে কে আটকায়ে রাখতে পারসে বাধা দিয়া? স্কোয়াড্রন লিডার সুলতান মাহমুদ আর ফ্লাইং অফিসার বদরুল আলম জিডি (পি) সেই অসম্ভব কে সম্ভব করলেন। এই ওয়েট নিয়াও আকাশে উড়ল বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর Alouette-III হেলিকপ্টার।

উড়ার পর দেখা দিল আরেক সমস্যা। দিনের বেলা হইলে এই হেলিকপ্টার এ সাধারণত ভিজুয়াল ফ্লাইট করা হয়। অর্থাৎ নিচের নদী নালা, মাঠ ঘাট দেইখা চালানো যায়। কিন্তু ডিসেম্বর এর শীত এর রাত। ঘন কুয়াশা। কিচ্ছু দেখা যাচ্ছিল না। বেশি নিচু দিয়ে উড়তে গেলেও গাছ এর সাথে ধাক্কা লাগতে পারে। সুলতান মাহমুদ স্যার বলসেন, ওই দিন পূর্ণিমা ছিল। চাঁদ আর মুখস্ত বিয়ারিং ( অক্ষাংশ, দ্রাঘিমাংশ) এর উপর ভরসা কইরা তারা হেলিকপ্টার নিয়া বাংলাদেশের সীমানায় ঢুকলেন।

স্কোয়াড্রন লিডার সুলতান মাহমুদ জানতেন যে তিনি যখন ২নম্বর সেক্টরে যুদ্ধ করছিলেন তখন ক্যাপ্টেন হায়দার দাউদকান্দি-কুমিল্লা রোড এর উপর ইলিয়ট গঞ্জ ব্রিজ উড়ায় দিসিলেন। একটু খুঁজতেই উপর থেইকা পায়া গেলেন সেই ভাঙ্গা ব্রিজ । এইবার এই মার্কার ধইরা আরেকটু আগাইলেন।

২য় বাধা আসলো দাউদকান্দির কাছে শহিদ নগর জায়গাটা তে। এই খানে একটা চিকন রেডিও রিলে টাওয়ার ছিল । পাইলট রা সতর্ক না থাকলে আরেকটু হইলেই এই টাওয়ার এ ধাক্কা লাগতো আর প্রথম মিশন ওই খানেই শেষ হয়া যাইত।

পাইলট দুইজন বুদ্ধি কইরা ঢাকার দিকে যাওয়ার হাইওয়ে ফলো করতে করতে আগাইতে থাকলেন। হেলিকপ্টার পৌঁছাইল শীতলক্ষা নদীর কাছে। তার পর ই নারায়নগণ্জ আর তারপর ই টার্গেট তেলের ডিপো। এই খানে আসলো ৩য় বাধা টা।

স্কোয়াড্রন লিডার সুলতান মাহমুদ আর ফ্লাইং অফিসার বদরুল আলম জিডি (পি) হঠাত খেয়াল করলেন যে শীতলক্ষ্যা নদীর উপর দিয়া গেসে ৩৩,০০০ কেভির হাই টেনশন বৈদ্যতিক তার। সেই তার এর উপর দিয়ে অথবা নিচ দিয়া হেলিকপ্টার নিয়া পার হইতে হবে। চিন্তা করার সময় কয়েক সেকেন্ড। সুলতান মাহমুদ ডিসিশন নিলেন নিচে দিয়ে পার হবেন (যেহেতু লোডেড হেলিকপ্টার তাই উপর দিয়ে যাইতে গেলে যদি এনাফ লিফট না পাওয়া যাইত তাইলে প্রব্লেম হইত)। রুদ্ধশ্বাস কয়েক সেকেন্ড পার হইল। গানার মিয়া শিউর লিফলেট এর বস্তা জড়াইয়া ধইরা দুয়া পরতাসিল। তারা নিরাপদে হেলিকপটার নিয়া পার হয়া আসলেন তার এর নিচ দিয়া।

কয়েক মিনিট এর মধ্যে তারা গোদনাইলে তেলের ডিপোর কাছে আইসা পরলেন। কুয়াশা নাই। পূর্ণিমায় আলোয় দেখা যাইতাসে টার্গেট। দুই পাইলট হেলিকপটার টাকে এক চক্কর ঘুরাইয়া আইনা এক জোড়া রকেট ফায়ার করলেন টার্গেট এর দিকে। কয়েক সেকেন্ড এর জন্য সময় থমকায় গেল। আর একদম বুলস আই। প্রথম শট এই লক্ষ ভেদ করলেন আমাদের দুই বৈমানিক। ৩০ ফুট উঁচা পর্যন্ত উঠসিল আগুনের শিখা।

আরেক টা সার্কেল ঘুইরা আসলেন তারা। হেলিকপ্টার টাকে এইবার আরো একটু লো তে নামায় আনলেন। সামনে আবারো টার্গেট। ১৪ টার থেইকা রকেট বাকি ১২ টা। তারা ১২ টা রকেট এই বার এক সাথে ফায়ার করলেন টার্গেটের দিকে। এইবারও সব গুলা রকেট লক্ষ্যভেদ করল। আগুনের শিখা এত বড় হইসিল যে আরেকটু হইলে হেলিকাপ্টার টাই আগুনের মধ্যে পড়ত। মিশন সাকসেসফুল। টার্গেট টারমিনেটেড। এইবার আবারো সব বিপদ মাথায় নিয়া ফল ব্যাক টু বেজ।

ফেরার সময় গর্বে আনন্দে ভরপুর পাইলট রা গানার কে জিজ্ঞেস করলেন,

— কিরে লিফলেট ফালাইসিলি ঠিক মত?
>> জি স্যার
— বস্তার মুখ খুইলা নিসিলো তো
>> ইয়ে মানে উত্তেজনায় বস্তার মুখ খুলতে ভুইলা গেসিলাম স্যার
— আয় হায়। আচ্ছা বস্তা টা ফালাইসিলি তো জায়গা মত? পাকিস্তানী আর সাধারণ মানুষ বুঝবে তো যে বাংলাদেশ বিমান বাহিনী আসছিল?
>> জি স্যার। এক্কেরে আগুনের মধ্যে ফালায় দিসি স্যার।

সেদিন পাইলট দের হাসির শব্দ মনে হয় হেলিকপ্টার এর শব্দ কেও ছাড়ায়া গেসিল।

৪টা ডিসেম্বর ভোরের আলো ফোটার আগেই তারা নিরাপদে তেলিয়ামুড়ায় ল্যান্ড করেন। শেষ হয় কিলো ফ্লাইট এর বহু দুঃসাহসিক অভিযান এর প্রথম টা। বাকি অভিযান গুলা নিয়াও একে একে লিখার আশা রাখি। দুয়া কইরেন জাতে শেষ করতে পারি লিখা। অনেকে জানেই না যে মুক্তিযুদ্ধে আমাদের একটা এয়ার ফোরস ছিল। কি অদ্ভুত। তাই আমার মনে হয় এক জন কে ইন্সপায়ার করতে পারলেও আমার অর্জন ওই টাই।

এই বারুদ জাতির জন্য একজন মানে একটা দেশলাই । আমাদের শুধু সেই দেশলাইটা খুইজা বাইর করা লাগবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *