লেখার তারিখঃ মে ১৭, ২০১৫ । ১১.৩০ পি.এম
আজকে আবার কিলো ফ্লাইট নিয়া লেখার মুড আসছে। তিন বছর আগে এই দিনে মানে ১৭ই মে, ২০১২ আমি কিলো ফ্লাইট নিয়া পড়া শুরু করসিলাম। আল্লাহর রহমতে এত দিনে আইসা কিছুটা গুছায়া লেখার সাহস করতে পারতাসি। সমস্যা টা হইল ইনফরমেশন পাওয়া নিয়া আর পাওয়া গেলেও এত ছড়াইয়া ছিটাইয়া গেসে পিস গুলা যে আমার মত বেসামরিক লোক এর পক্ষে মুল ঘটনা বুইঝা অনুধাবন করা অনেক কঠিন ছিল। আর যতই দিন যাইতাসে আরো ছড়ায়া যাইতাসে কুচি করা কাগজের মত।
আগের লেখা গুলায় লিখসিলাম বাংলাদেশ বিমানবাহিনী কিভাবে গঠিত হইসিল আর কিলো ফ্লাইট ই বা কিভাবে আসছিল। আজকে কিলো ফ্লাইট এর অপারেশন শুরুর আগ পর্যন্ত ঘটনা গুলার একটা সামারি দেয়ার চেষ্টা করব আর পরের লেখা টা হবে বিমান গুলার আলাদা আলদা মিশন এর বর্ননা নিয়া।
যে কোন বিমান আকাশে উড়ার আগে তার একটা রেজিস্ট্রেশন নাম্বার লাগে। সেইটা মিলিটারি ই হোক আর সিভিল। এই রেজিস্ট্রেশন টা নিয়ন্ত্রণ করে ICAO (International Civil Aviation Organization). যেহেতু বাংলাদেশ তখনো স্বাধীন না তাই আমাদের কোন সিভিল এভিয়েশন অথারিটি ও ছিল না। তাই কিলো ফ্লাইট এড় বিমান গুলার রেজিস্ট্রেশন নাম্বার দ্যায় ভারত। অর্থাৎ রেজিস্ট্রেশন এ ভারতীয় প্রি ফিক্স ব্যাবহার করা হয়। গাড়ির ক্ষেত্রে যেমন যেখানে রেজিস্ট্রেশন হয় তার একটা প্রি ফিক্স থাকে লাইক ঢাকা মেট্রো, চট্ট মেট্রো ইত্যাদি, ওই রকম প্লেনেরও থাকে। বাংলাদেশের জন্য S2, S3 , আমেরিকার জন্য N, ব্রিটেনের জন্য G, ভারতের জন্য VT এরকম। আর ICAO এর বিধি নিষেধ না থাকায় ইচ্ছা মত রেজিস্ট্রেশন দেওয়া হয় যেমন একই রেজিস্ট্রেশন দুই বিমান এর দেয়া হয়। কিলো ফ্লাইট এর বিমান গুলার রেজিস্ট্রেশন দেওয়া হইসিল এমনঃ
১। DC-3 Dakota এর জন্য: VT-EBA
২। DHC-3 Otter এর জন্য: EBR
৩। Alouette-III হেলিকপ্টারের এর জন্য: VT-EBR
EBR/EBA ক্যান সেইটা নিয়া অনেকে অনেক কোথা বলেন। তবে সব চেয়ে গ্রহণযোগ্য হইল East Bengal Regiment আর East Bengal Army থেইকা EBR আর EBA.
রেজিস্ট্রেশন পাওয়ার পর এখন শুধু বাকি থাকে অপারেশন এর দিন খন আর স্ট্রেটেজি ঠিক করা। এই ক্ষেত্রেও মূল ক্ষমতা ছিল ভারতের হাতে। কারণ বিমান গুলার মেইন্টেনেন্স করত ভারত। জ্বালানি, রকেট, বোমা, ফ্লাইট ট্রেইনিং সব ই দিতাসিল ভারতীয় বিমান বাহিনী। তাই প্লানিং এর দায়িত্ব ও আসে ভারতীয় বিমান বাহিনীর হাতে। ঠিক করা হয় প্রথম অপারেশন চালানো হবে ৩ রা নভেম্বর।
২রা নভেম্বর, ১৯৭১। সকালে অপারেশন এর প্ল্যান অনুসারে Alouette-III হেলিকপ্টার টা কৈলাশহর গিয়া অবস্থান ন্যায়। সবার মধ্যে টান টান উত্তেজনা। পরের দিন প্রথম অপারেশন। কিন্তু এই দিন সকাল সাড়ে দশটায় একটা মেসেজ আসে দিল্লী থেইকা। সেইখানে বলা হয় , DC-3 Dakota বিমানটা কোনো অপারেশন চালানো যাবে না। সেইটা শুধু মাত্র বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর কমান্ডার ইন চিফ এর পরিবহন এর কাজে ব্যাবহার করা হবে। আরো ব্যাড নিউজ হইল, ৩ রা নভেম্বর এর অপারেশন পোস্টপন বা স্থগিত করা হইসে। এই খবর পায়া কিলো ফ্লাইট এর পাইলট রা অনেক টাই হতাশ হন কিন্তু কিছু করার ছিল না। পরবর্তী অপারেশন এর তারিখ এক মাস পিছায় দ্যায় ভারত। ঠিক হয় পরবর্তী অপারেশন এর তারিখ ৩রা ডিসেম্বর।
৬ই নভেম্বর, ১৯৭১। DC-3 Dakota বিমানটা ব্যারাকপুর বিমান ঘাটিতে নিয়া যাওয়া হয়। কিলো ফ্লাইট এ এখন শুধু ২ টা বিমান আছে। Alouette-III হেলিকপ্টার আর DHC-3 Otter। এই দুইটা বিমান দিয়াই আমদের বিমান বাহিনী ডিসেম্বর এর ৩ তারিখ থেইকা ১১ তারিখ পর্যন্ত একটা না , দুইটা না মোট ৪৬ টা মিশন কমপ্লিট করে। যার প্রত্যেকটাই ছিল সুইসাইডাল মিশন।
আগের লেখার বলা হইসে যে বিমান বাহিনীর প্রথম ঘাটি ঠিক করা হইসিল ডিমাপুরে। কিন্তু এইটা ঘাটি হইলে দূরত্ব একটু বেশি পরে তাই শমশেরনগর বিমানবন্দর থেইকা মাত্র ৫০ কিলোমিটার দূরে পরিত্যাক্ত বিমানঘাঁটি কৈলাশহর এ কিলো ফ্লাইট এর বেজ শিফট কৈরা নিয়া যাওয়া হয়।
আমি তো মিলিটারি স্ট্রেটেজি বুঝি না, কিন্তু পইড়া মনে হইসে ভারত অনেক কনফিউজড ছিল বাংলাদেশ নিয়া। তারা ভাবতেসিল যদি বাংলাদেশের কোন বিমান পাকিস্তানী রা গুলি কইরা ফালায় দ্যায় তাইলে তারা রেজিস্ট্রেশন দেইখা শিউড়লি মনে করব এগুলা ভারত দিসে। তখন তারা এই টা মিডিয়া তে দেখাইয়া সারা বিশ্বের সাপোর্ট পাইব। দেখাইব যে ভারত কত খারাপ, তাই ভারত কে আক্রমণ করা ফরয ইত্যাদি।
সৌভাগ্য ক্রমে ৩রা ডিসেম্বর পাকিস্তানি বিমান বাহিনী ভারতের ৭ টা বিমান ঘাটিতে আক্রমণ করে। কিলো ফ্লাইট এর নির্ধারিত অপারেশন এর ডেট ই ছিল ৩রা ডিসেম্বর দিবাগত রাত্রে। পাকিস্তান এই আক্রমণ করার পর এখন ভারতীয় বিমান বাহিনী স্ট্রং কারন খুইজা পায় আরো। শুরু হয় কিলো ফ্লাইট এর অপারেশন।
কিলো ফ্লাইট এর বিমানগুলা তাদের রকেট আর মেশিন গান এর গুলি শেষ কইরা ফিরা আসতো কিলো ফ্লাইট এর বেজ ভারতের কৈলাশহরে। তারপর আবার রিলোড কইরা, মেইটেনেন্স এর ক্লিয়ারেন্স নিয়া ফিরা যাইত আক্রমণে। এই ভাবে রাত দিন অমানুষিক পরিশ্রম কইরা আমাদের কিলো ফ্লাইট এর সদস্যরা দুইটা মাত্র বিমান আর মাত্র ৮ দিনে ৪৬ টা মিশন সফল ভাবে শেষ করেন।
কিলো ফ্লাইট যে সব জায়গায় পাকিস্তানী বাহিনীর উপর হামলা চালাইসিল সেগুলা হইল,
চট্টগ্রাম, সিলেট, ফেঞ্চুগঞ্জ, শমসেরনগর, হবিগঞ্জ, মৌলভীবাজার, শ্রীমঙ্গল, শেরপুর, সাদিপুর, কুমিল্লা, দাউদকান্দি, নরসিংদী, নারায়ণগঞ্জ, ঢাকা, কুলাউড়া এবং ভৈরব বাজার।
আগামী লেখায় DHC-3 Otter আর Alouette-III হেলিকপ্টারের করা আলাদা আলাদা মিশন গুলার ডিটেইল নিয়া লেখার ইচ্ছা রাখি। যদি আপনার এই গর্ব করার ইতিহাস পড়তে আমার মতই দমবন্ধ করা ভাল্লাগে তাইলে দয়া কইরা বাসার ছোট দের এই জিনিশ গুলা জানায়েন। নাইলে এই ইতিহাস গুলা হারায় যাবে, অলরেডি হারাইয়া যাইতাসে ভয়াবহ রেট এ।