৪০/৩৬৫

লেখার তারিখঃ এপ্রিল ৮, ২০১৫ । ১১.৪২ পি.এম

১৯১৪ সাল এর তার জন্ম। কিন্তু যখনকার কথা বলতাসি তখন তার বয়স তেরো কি চৌদ্দ। তখন সবাই তারে ডাকে “ঠান্ডার বাপ”। সে খুবি শান্ত আর লাজুক। তাই এইটাই তার নাম হয়া গেসে।

তারে কেউ কেউ নকশা করা পিঠা খাইতে দিলে সে পিঠা খায় না, লুকায় বাড়িতে নিয়া যায়। তারপর তন্ময় হয়া দ্যাখে পিঠার কত নকশা। সবাই যখন নদীর পারে খেলে তখন সে তাকায় থাকে নদীর দিকে।তাঁতি পাড়ায় গিয়া হারায় যায় ছেলেটা। অবাক হয়া দ্যাখে অশিক্ষিত তাঁতি রা কত নিখুত ভাবে সুতার হিসাব, রঙের হিসাব করে বানায়া ফেলে কত সুন্দর ছবি কাপড়ের জমিনে। সে কুমার পাড়ায় গিয়া বইসা যায় কুমার দের সাথে। কুমারেরা হাড়ী কলসি বানায়া তার উপর নকশা করে। দেখা দেখি সে ও করে। কুমার দের দেখা দেখি সে ও হাতি, ঘোড়া, পুতুল এগুলা বানাতে চেষ্টা করে।

১৯২৭ সাল। ঠান্ডার বাপ তখন কিশোর গঞ্জ এর স্কুল এ যায়। যাওয়ার পথে যাই দ্যাখে ভাল লাগে। মনের ভিতর গাইথা রাখে আর স্কুলের খাতার ফাকে ফাকে আকে সেই সব ছবি। কাউকে দেখায় না। এত দিনে তার ঠান্ডার বাপ নাম টাও একটু ভদ্র হয়া “টুনু” হইসে। সবাই আদর কইরা ডাকে টুনু।

টুনুর স্কুলের নাম মৃত্যুঞ্জয় হাইস্কুল। টুনুর বাবা পুলিশ। তখন বদলী হয়া আসছেন ময়মনসিংহে। স্কুলে যাওয়ার পথে আগফা স্টুডিও নামে একটা ফটো তোলার দোকান ছিল। ওই খানে আড্ডা দিতে আসে দুই তিন জন কোলকাতা আর্ট কলেজের ছাত্র। তারা গল্প করে তাদের কলেজ এর আর টুনু হা করে শোনে সেই রুপকথার রাজ্যের গল্প।

হঠাত একদিন টুনু ময়মনসিংহ থেকে উধাউ। কোথাও খুইজা পাওয়া যাইতাসে না। পুলিশ বাপ তো পুরা থানা লাগায় দিলেন খুজতে । কিন্তু কোথাউ নাই। টুনুর মা কান্তে কান্তে অস্থির।

দুই দিন যায়, তিন দিন যায় টুনুর কোন খোজ পাওয়া যায় না। ভাই বোন রা মুখ শুকনো কইরা বইসা থাকে। মা তো কানতে কান্তে শয্যাশায়ি আগেই। পুলিশ বাবা শুধু ফ্যাল ফ্যাল কইরা তাকায় আকাশের দিকে। ফিরা আয় টুনু, ফিরা আয়।

পাঁচ দিন এর দিন দেখা গেলো রেল লাইন ধরে লাল চাদর পরে একজন হাইটা আসতাসে। কাছে আসলে দেখা গেলো, আরি, এই তো টুনু। সবার মধ্যে কারাকারি পইরা গেল। হাজার হাজার প্রশ্ন সবার। কই গেসিলি? কই ছিলি? ক্যান এই ভাবে পালায় গেসিলি? টুনু শুধু এক্টাই জবাব দিল , “ গেসিলাম কুলকাতা। আর্ট ইস্কুল দেখতে। দেইখা আসছি। ভর্তি হউনের নিয়ম কানুন জাইন্না আসছি।“ টুনু যে ছবি আঁকা শিখতে চায়, সবার এক ঘটনা দিয়াই জানা হয়া গেল।

দুই বছর পর। ১৯৩০ সাল। বোম্বাই থিকা “News Chronicle” নামে একটা পত্রিকা বাইর হইত। সেই পেপারে এক ইংরাজ ব্যাডায় একটা ছবি আঁকা কন্টেস্ট এর ঘোষণা দিলেন। তিনি একটা গলফ খেলার ফটুক দিলেন পেপারে আর নিচে বইলা দিলেন এই ফটোগ্রাফ টার ই ছবি আঁকতে হবে। কাগজে, পেন্সিল দিয়া।

টুনুর কাছে এই বিজ্ঞাপন টা অনেক এক্সাইটিং লাগ্লো। সে দেইখা দেইখা দুইটা ছবি আইক্কা ফেল্ল এক বসা তেই। আঁকার পর হুশ হইল, পাঠাইতে তো হবে বোম্বাই। এত পয়সা কই। স্কুলের ছাত্র মাত্র তখন। থাক। দরকার নাই আমার। একটা ছবি সে দিয়া দিল তার এক বন্ধুরে আরেকটা ছবি পত্রিকা টা সহ তোষকের নিচে লুকায় রাইখা দিল।

দুই দিন পর টুনুর বাবা কি জানি একটা জিনিশ খুজতে আইসা তোশক উল্টায়া ছবিটা আর পত্রিকাটা পাইলেন। যা বুঝার বুইঝা নিলেন সাথে সাথেই। তিনি চুপ চাপ ছবিটা পাঠায় দিলেন বোম্বাই। তখনো সময় আছে জমা দেওয়ার।

তারপর কয়েক দিন পর এর কথা। টুনুর আর এই প্রতিযোগিতার কথা মনে নাই। টুনু বসে ছিল পুকুর ঘাটে। টুনুর বন্ধু ঋত্তিমা ঘটক দৌড়াতে দৌড়াতে আইসা টুনুর সামনে দাড়াইল। “ওরে টুনু কি করছস রে তুই”। টুনুর চোখে তখনো সন্দেহ। আবার কি করলাম? ঋত্তিমা টুনুর চোখের সামনে মেইলা ধরল আগের দিন এর স্টেটসম্যান পত্রিকা। সেখানে টুনুর আঁকা সেই ছবিটা বড় বড় করে ছাপা হয়েছে। আর তার নিচে লেখা,

“সমগ্র ময়মনসিংহ, সমগ্র বাংলাদেশ এবং সমগ্র ভারতবর্ষের মধ্যে প্রথম হয়েছে এই ছবি। শিল্পীর নামঃ

জয়নুল আবেদিন।“

যার বয়স ছিল তখন মাত্র, ১৬। যাকে আমরা এতক্ষন ঠান্ডার বাপ আর টুনু নামে চিনেছি। যাকে আমরা এখন আদর করে শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন ডাকি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *